Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ্

ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ্

ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ্ –
মাওলানা মুহাম্মদ জহুরুল আনোয়ার >
ভূমিকা
বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপন্ন মানবতার মুক্তি ও উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে আবির্ভূত হন। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনপূর্ব ছয়শ বছরকাল সারা পৃথিবীতে নৈতিকতা, মানবিকতা ও কল্যাণের চরম অবক্ষয় চলছিল। তিনি গোঁড়ামী, কুসংস্কার, নিপীড়ন, নির্যাতন, বঞ্চনা, বৈষম্যের স্থলে মানবতার মুক্তিবার্তা নিয়ে আসেন। তার পঞ্চাশ বছরের মক্কি জীবনে তিনি ইসলামের সামাজিক নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করেন এবং তের বছরের মাদানী জীবনে ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামের পূর্ণতা দান করেন। মানবিক আদর্শের দীপ্তিতে আলোকিত কল্যাণধর্মী সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর নুবুওয়াতী জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। তিনি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-নির্ধন, প্রভূ-ভৃত্য, আমীর-ফকীরের ভেদাভেদ গুছিয়ে মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর কালজয়ী আদর্শ ও অনুপম শিক্ষায় দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ নিহিত। তাঁর আলোকিত জীবনের প্রতিটি কথা, কাজ ও অনুমোদন মানব জাতির মুক্তির আদর্শ। অন্যায় ও বঞ্চনা দূর করে সমাজের মধ্যে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, সংহতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আজীবন অতুলনীয় ত্যাগ, সাধনা, ভূমিকা ও অবদান মানব জাতির অনুপ্রেরণার উৎস।
আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَة.ٌ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহ্র রাসূলের মধ্যে রয়েছে অতি উত্তম আদর্শ।’ ১
মানবজাতি একটি দেহের ন্যায় অখণ্ড সত্তা। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন পৃথক করে দেখা যায় না, সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকেও পরস্পরের তুলনায় খাটো করে দেখা যায় না। কর্মে, ব্যবসায় এবং পদমর্যাদায় পরস্পর পৃথক হলেও সৃষ্টিগতভাবে সকল মানুষ সমান। সকল মানুষ আল্লাহ্র বান্দাহ। সকলের আদি পিতা হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সমুদয় সৃষ্টি আল্লাহ্র পরিবারভুক্ত। আল্লাহ্র নিকট সর্বাধিক প্রিয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহ্র অপরাপর সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহ করে’। ২
ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সদ্ভাব ও সুস্পর্ক বজায় রাখার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। মুসলমানদের মত তারাও নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর জান-মাল, সম্মান-মর্যাদা, ধর্মাচার, সংস্কৃতি লালন ও চাকুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে বলেন, ‘মনে রেখ, যে ব্যক্তি কোন মু‘আহিদ (চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম) নাগরিকের প্রতি অত্যাচার করে, কষ্ট দেয়, সম্মানহানী করে অথবা তার কোন সম্পদ জোর করে ছিনিয়ে নেয়, ক্বিয়ামত দিবসে আমি তার বিপক্ষে অবস্থান নেব।’ ৩
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামে যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। উল্লেখযোগ্যের মধ্যে রয়েছে দাসপ্রথা বিলুপ্ত, শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, মানবিক নীতিমালা প্রণয়ন, সার্বজনীন মানবাধিকার সুরক্ষা ও বাস্তবায়নে মদীনা সনদ প্রণয়ন, বর্ণ-গোত্রীয় বৈষম্যের অবসান, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, মক্কা বিজয়ে ক্ষমার অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত, মানবতার আদর্শ সম্বলিত বিদায় ভাষণ।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত
মানবতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎকালীন সমাজে প্রচলিত দাস প্রথা উচ্ছেদে সাহসী ভূমিকা রাখেন। তিনিই প্রথম, যিনি দাস প্রথার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তখনকার যুগে গ্রীস ও রোমান সাম্রাজ্য দাস প্রথারভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্টজগৎ ও আরব সমাজেও ছিল দাসপ্রথার অবাধ প্রচলন। প্রভূরা নিজেদের মালিক-মুনীব মনে করে দাসদের শ্রম শোষণ করতেন, তাদের দ্বারা অমানুষিক পরিশ্রম করাতেন। অনেক সময় তাদের উপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। দাসদের জীবন ছিল পশুর ন্যায়। ৪ পণ্যদ্রব্যের মত হাটবাজারে তাদের বিক্রি করা হত। তাদের কোন অধিকার ছিল না। শতাব্দী প্রাচীন দাস প্রথার অবসানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং দাস মুক্তিকে সাওয়াবের উপায় ঘোষণা করেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাসদের মুক্ত করে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, তাই কারো অধীনস্থ হওয়া তার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মানবসন্তান স্বভাবগত চাহিদা ও ঈমানের দাবিতে ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যকলাপ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারেনা। দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তিই তার জীবন, তার স্বাধীনতা ও তার শক্তি। দাস মুক্তিতে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দেন, ‘ক্রীতদাসরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা যা আহার করবে, তাদেরকেও তা আহার করতে দেবে এবং তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও সেরূপ পরিধান করাবে। তারা যদি ক্ষমার অযোগ্য কোন অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাদের মুক্ত করে দাও; তাদের শাস্তি দিও না।’ ৫
‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমান দাসকে দাসত্ব হতে মুক্ত করবে, তার (আযাদকৃত দাসের) প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আল্লাহ্ তার (মুক্তিদানকারীর) প্রতিটি অঙ্গকে দোযখের আগুন হতে মুক্তি দান করবেন।’৬
দাসমুক্তির জন্য হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ঘোষণা দেননি, নিজে দাস মুক্ত করে বাস্তব দৃষ্টান্তও স্থাপন করেন। সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমও হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণ করে দাস মুক্ত করেন। ফলে মুক্ত দাস তার মানবাধিকার ফিরে পেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীতদাস যায়দ ইব্ন হারিসাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। হযরত সালমান র্ফাসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত সুহায়ব রূমী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রমুখ সামাজিক মর্যাদা লাভ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খিদমত আন্জাম দেন।
শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
প্রাচীনকাল হতে শ্রমিকদের প্রতি মালিকপক্ষ ন্যায্য মজুরী নির্ধারণ, অতিরিক্ত শ্রম আদায়, প্রাপ্য মজুরী প্রদানে গড়িমসি, লভ্যাংশ প্রদানে অনীহা প্রভৃতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছিল। এতে শ্রমজীবী ও পুঁজি মালিকদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, শ্রমিক অসন্তোষ, সহিংসতা প্রকাশ পেয়ে আসছিল। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হত। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমিক ও মালিকের অধিকার ও পারস্পরিক দায়িত্ব সম্পর্কে নীতিমালা পেশ করেন। শ্রমিক তার দক্ষতার ভিত্তিতে ন্যায্য পারিশ্রমিক পাবে। এখানে পীড়ন ও শোষণের অবকাশ নেই। কর্মের পারিতোষিক নির্ধারণ করেই শ্রমিক নিয়োগে হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা রয়েছে। কাজ অনুপাতে শ্রমের মজুরী না দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, ‘শ্রমিককে শ্রমজনিত ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক প্রদান কর। শ্রমিকদের তাদের কাজের লভ্যাংশ প্রদান করবে। কেননা আল্লাহ্র শ্রমিকদের বঞ্চিত করা যায় না। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য পরিশোধে ধনীদের বাহানা করা যুলুম।’ ৭
মালিকের বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান ও কারখানার আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, উৎপাদিত পণ্য, কাঁচামাল ইত্যাদি শ্রমিকের নিকট আমানত। সেগুলোর চুরি, আত্মসাৎ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও ক্ষয়ক্ষতি করা নিষিদ্ধ। চুক্তির ধারা অনুসারে যথাযথভাবে কাজ সম্পন্ন বা সম্পাদন করা শ্রমিকের কর্তব্য। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোন লোকের অধীনস্থ শ্রমিক স্বীয় মালিকের সম্পদের রক্ষক এবং সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে রক্ষক এবং তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ ৮
মানবিক নীতিমালা প্রণয়ন
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করেন, যার অনুকরণ ও অনুশীলনে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণ এ নীতিমালা অনুসরণ করায় সমাজে তা প্রদর্শন নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকে। তাঁর অনুসৃত নীতিমালায় রয়েছে ন্যায়পরায়ণতা, সাম্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ, মর্যাদাবোধ, দান-অনুদান, আত্মত্যাগ, আতিথেয়তা, সুপরামর্শ প্রভৃতি। পারস্পরিক দয়া, সৌহার্দ্য ও সৌজন্য সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। সহমর্মিতাসুলভ গুণ মানুষকে একে অপরের নিকটে নিয়ে যায়। হিংসা-বিদ্বেষ বিভেদের বীজ বপন করে। এতে সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ভিত্তি ছিল পারস্পরিক সম্মানবোধ, মানবিকতাবোধ ও ন্যায়বিচার। ৯
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ইনসাফপূর্ণ যে সমাজ ক্বায়িম করেন তার ভিত্তি ছিল ধার্মিকতা, মানবিকতা ও নৈতিকতা। মানুষ যদি রিপুর তাড়নায় পরাভূত হয়, তখন সে সুস্থ সমাজের বিকাশধারায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে না। মনুষ্যত্বে উজ্জীবন, চারিত্রিক উৎকর্ষ ও নৈতিক উপলদ্ধি সুস্থ সমাজ বিকাশের সহায়ক। আর ইন্দ্রিয়জাত প্রবণতা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, অনিষ্টকর প্রথা সমাজের সুস্থতার ভিত্তিমূলকে নড়বড়ে করে দেয়, এতে জন্ম হয় যুলুম ও বে-ইনসাফী। এ উদ্দেশ্যেই তিনি জুয়াখেলা, মধ্যপান, নেশাগ্রহণ, কুসীদপ্রথা, যিনা-সমকামিতা ও অহেতুক রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দেন। ১০
ফলে সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ভয়াবহতা থেকে মানুষ রক্ষা পায়। মদ্যপান, জুয়া, যাবতীয় অমার্জিত নীচ স্বভাবের অনিষ্ট কার্যকলাপ ও সব ধরনের আতিশষ্য হল খ্রিস্ট-ইয়াহূদী ও পৌত্তলিক সমাজের অভিশাপ। তিনি এ অভিশাপ হতে মানুষকে মুক্তি দিয়ে ধর্ম নিয়ন্ত্রিত ও মানবিকতায় উজ্জীবিত নতুন সমাজের গোড়াপত্তন করেন। যা বিশ্ব মানবতার জন্য হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইহ্সান।
সার্বজনীন মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নে মদীনা সনদ প্রণয়ন
৬২২ খ্রিস্টাব্দে যখন হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করেন তখন সেখানকার জনগণ পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত ছিল। তখন তিনি বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র ও ধর্মমতের জনগোষ্ঠীকে একই বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে আনার জন্য প্রণয়ন করেন ‘মদীনা সনদ’ ঞযব ঈযধৎঃবৎ ড়ভ গধফববহধয। ইতিহাসে এটাই প্রথম লিখিত সংবিধান। এর পূর্বে শাসকের মুখোচ্চারিত কথাই ছিল রাষ্ট্রীয় আইন। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের শাসননীতি। ৪৭টি ধারা সম্বলিত মদীনা সনদের প্রধান দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. মদীনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইয়াহূদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি ঈড়সসড়হবিষঃয গঠন করবে।
২. হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রধান নির্বাহী হবেন এবং পদাধিকারে তিনি মদীনার সর্বোচ্চ বিচারালয় ঈড়ঁৎঃ ড়ভ অঢ়ঢ়বধষ-এর সর্বময় কর্তা হবেন।
৩. পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে; মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় বিনাদ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৪. কুরায়িশদের সাথে কেউ কোন প্রকার সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না এবং মদীনাবাসীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কুরায়িশদের সাহায্য করতে পারবে না।
৫. স্বাক্ষরকারী কোন সম্প্রদায়কে বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বহিঃশত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করবে।
৬. বহিঃশত্রুর আক্রমণে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ স্ব স্ব যুদ্ধ-ব্যয়ভার বহন করবে।
৭. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করা হবে; এর জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী ও দোষী করা যাবে না।
৮. মদীনা শহরকে পবিত্র ঘোষণা করা হল এবং রক্তপাত, হত্যা এবং অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হল।
৯. অপরাধীকে অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সকল পাপী বা অপরাধীকে ঘৃণা করতে হবে।
১০. ইয়াহূদীদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১১. দুর্বল ও অসহায়কে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
১২. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীরা কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১৩. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী ফায়সালা দেবেন।
ইতিহাস প্রমাণ করে, এ ঐতিহাসিক সনদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদমান কলহ ও অন্তর্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সম্প্রীতি, প্রগতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি করে। উগ্রসাম্প্রদায়িকতা, গোত্রীয় দম্ভ, ধর্মবিদ্বেষ ও অঞ্চলপ্রীতি মানবতার শত্রু ও প্রগতির অন্তরায়। মদীনা সনদে সামাজিক নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সনদের প্রতিটি ধারা পর্যালোচনা করলে এতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মানবাধিকার ঘোষণার প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রতিভাত হয়। ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস্, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস এ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস্ এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ঞযব টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং-এর বহু বছর আগে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষণা করে এর যথাযথ সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যান। পরস্পর বিরোধী ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সম্পাদিত এ সনদ সকল মানুুষ ও অখণ্ড মানবতার চূড়ান্ত উত্তরণ।
বর্ণ-গোত্রীয় বৈষম্যের অবসান
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শতাব্দীর এমন এক ক্রান্তিকালে নতুন সমাজ গড়ায় প্রয়াসী হন যখন পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে বর্ণপ্রথা, বর্ণবৈষম্য, বংশ কৌলিন্য ও আভিজাত্যের দম্ভ মানুষকে গৃহপালিত জন্তু বা বিশেষ বৃক্ষের চেয়ে হীন পর্যায়ে নিয়ে আসে। তখন জীব-জন্তু ও বৃক্ষবিশেষকে অর্চনা করা হত। সাধারণ মানুষের তুলনায় এসব জন্তু-বস্তুর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। তিনি মানুষের মনন ও মানসিকতায় এ কথা জাগ্রত করতে সক্ষম হন যে, আল্লাহ্র প্রতিনিধি মানুষই হলেন সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশী মর্যাদাবান, মূল্যবান, সম্মানের যোগ্য ও ভালবাসার পাত্র। আল্লাহ্ পাক মানুষের কল্যাণের জন্যই সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا.
‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন করে দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিয্ক দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ ১১
এর চেয়ে অধিকতর সম্মান ও মার্যাদা মানুষের জন্য কী হতে পারে? আল্লাহ্ পাকের এ স্বীকৃতি মানুষকে পৃথিবীর উঁচু মর্যাদায় আসীন করে। এ প্রসঙ্গে হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্ব সহকারে বলেন, ‘সমুদয় সৃষ্টিজগত আল্লাহ্ তা‘আলার পরিবার। সুতরাং সৃষ্টিজগতের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সে-ই সবচেয়ে প্রিয়, যে আল্লাহ্র পরিবারের সাথে ন্যায় আচরণ করে’। ১২
মানবতার উঁচু মর্যাদা, আল্লাহ্র নৈকট্য ও সৃষ্টজগতের প্রতি ন্যায়পূর্ণ আচরণের গুরুত্ব প্রকাশের জন্য এর চেয়ে আর কী সুন্দর ভাষা হতে পারে?
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘আরবের উপর অনারবের, অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সকলে পরস্পর ভাই ভাই। সকল মানুষ আদমের বংশধর, আর আদম মাটি হতে তৈরি।’ ১৩
‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ যার মধ্যে আল্লাহ্ভীতি প্রবল।’ হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ ঘোষণা ছিল তৎকালীন সমাজের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ বংশ কৌলীন্য ও রক্তের মর্যাদা ছিল তখন সামাজিক আভিজাত্যের ভিত্তি। তিনি ঈমানদারদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় করে এক অভিন্ন দেহসত্তায় পরিণত করেন। হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সকল মু’মিন এক মানব দেহের মত, যদি তার চোখ অসুস্থ হয়, তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর যদি তার মাথা ব্যথা হয়, তখন তার পুরো দেহই ব্যথিত হয়।’ ১৪
পৃথিবীতে সকল মানুষই যে আল্লাহ্র দৃষ্টিতে সমান, কৃষ্ণ-শ্বেত, ধনী-নির্ধন সকলেই যে এক আল্লাহ্র সৃষ্ট মানুষ, সকলে যে পরস্পর ভাই ভাই, ধর্মীয় অধিকার যে সকল মানুষের সমান, তা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করে স্বীয় কর্ম ও আচরণে প্রমাণ করেন। ইসলামে সকলের জন্য স্বীকৃত হয়েছে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার। মদীনায় ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্বে অবিচার ও নানা স্বার্থপরতার কঠিন নিগড়ে মানুষ ছিল অসহায় বন্দী। মুক্তির দিশারী বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন মানুষের মুক্তি-বাণী। তিনি সারা জীবনের সাধনায় প্রতিষ্ঠা করেন এমন এক সমাজ, যে সমাজে মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, ব্যক্তি এবং জাতি-গোত্র পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। সমাজে মানুষ শির উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ লাভ করে। মানব জাতির প্রতি ইসলামের বৈপ্লবিক অবদানের মধ্যে মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারই হল অন্যতম। সমাজ জীবনে মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই পারস্পরিক সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, সমঝোতা, সদাচরণ প্রভৃতি অন্যায় ও যুলুমের অবসান করে ক্রমান্বয়ে মানব সভ্যতাকে গতিশীল করে তোলে। তাই দেখা যায়, মানুষ যখন পারস্পরিক সমঝোতা ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে অখন্ড ভ্রাতৃসমাজ গঠন করেছে, তখন তারা অগ্রগতি ও শান্তির পরিবেশ পেয়েছে। আর যখনই বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই পতন হয়েছে ন্যায়নীতি। বর্ণবাদ মানবতার জন্য বিরাট অভিশাপ। বর্ণ বৈষম্য থেকে মানবতার মুক্তির জন্য তিনি ঘোষণা করেন, ‘হে জনগণ! আল্লাহ্কে ভয় কর। কোন হাবশী গোলামও তোমাদের আমীর নিযুক্ত হলে, তিনি যদি আল্লাহ্র কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, তার কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে।’১৫
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে মদীনার মসজিদে মুয়ায্যিন নিয়োগ দান করে বর্ণবাদিতার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
তৎকালীন আরবদেশে মাত্রাতিরিক্ত গোত্রীয় আভিজাত্য এবং বংশীয় অহংবোধ মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে। তিনি আরবের সেই গোত্রীয় অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কার উচ্ছেদ করে সমঅধিকার নিশ্চিত করেন। তাঁর মতে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি তাক্বওয়া ও সচ্চরিত্র আর গোত্রীয় অহংবোধ অন্ধকার যুগের কুসংস্কার। তিনি তাঁর আযাদকৃত গোলাম যায়দ ইব্ন হারিসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর সাথে আপন ফুফাত বোন যায়নাব বিনত জাহাশ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর বিয়ে সম্পাদন করে সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ বিয়ে কুরায়শদের গোত্রীয় আভিজাত্য ও বংশীয় অহংবোধের প্রতি ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাঁর এ দৃষ্টান্ত কালজয়ী ও বিশ্বজনীন।
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা
প্রাক-ইসলাম যুগে পৃথিবীর কোথাও নারীর সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা ছিল অবহেলার পাত্র। সমাজে নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমাজের অর্ধেকাংশ নারীকে অবহেলা করলে সামাজিক সুবিচার সুদূর পরাহত হবে। এ চেতনায় তিনি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ঘোষণা দেন, ‘সাবধান! তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার কর, কেননা তারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সাবধান! তোমাদের স্ত্রীর উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমন তোমাদের উপরও রয়েছে তাদের অনুরূপ অধিকার। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের রক্ষক এবং স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণকারী।’ স্ত্রীলোকের মৃত পিতা, মৃত স্বামীর সম্পত্তি ভোগের অধিকার প্রদান করে তিনি ন্যায় ও ইনসাফ নিশ্চিত করেন এবং পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর কল্যাণকর নারীনীতি প্রণয়নের ফলে নারীরা পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায় এবং যোগ্য আসনে সমাসীন হওয়ার অধিকার পায়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ প্রথম, নারী তার ন্যায্য সম্পত্তি পাওয়ার এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার লাভ করে। তিনি নারীদেরকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী স্বামী গ্রহণেও পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। কন্যা সন্তান হত্যা নিষিদ্ধ করেন। কন্যা, মেয়ে, বোন লালন-পালনকারীদের জান্নাত লাভের সুসংবাদ দেন। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশ্ত লাভের সুসংবাদ দেন।
মক্কা বিজয়ে ক্ষমার অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন
দীর্ঘ ১৩ বছর মক্কার কুরায়িশরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের নৃশংস নির্যাতন চালায়। কিন্তু ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর তিনি প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। বিজয়ের মুহূর্তে তিনি অতীতের নির্যাতন ও দুর্ভোগের প্রতিশোধের পরিবর্তে মক্কাবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মুসলিম সেনাবাহিনী কোন প্রকার লুটতরাজে নিয়োজিত ছিল না, কোন গৃহ লুণ্ঠিত হয়নি, কোন মহিলার শ্লীলতাহানি ঘটেনি, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম গ্রহণে চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী পবিত্র কা’বাগৃহে ও আবূ সুফিয়ানের ঘরে যারা আশ্রয় নিয়েছিল এবং যারা নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছিল, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল। তারা নিরাপদে ছিল। তিনি মক্কা নগরকে পবিত্র ঘোষণা করে হত্যা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করেন। মক্কার কা’বাগৃহ চত্ত্বরে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘এক আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা পূরণ করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। জেনে রেখ! জাহিলিয়া যুগের সকল আভিজাত্যের অহংকার, রক্ত বা সম্পদের দাবী আমার এ দু’পায়ের নিচে আজ দলিত। তবে বায়তুল্লাহ্র খিদমত ও হাজীদের পানি পান করানোর ব্যবস্থাপনা এর ব্যতিক্রম।’
‘আজ তোমাদের প্রতি কোন প্রতিশোধ নেয়া হবে না। যাও! তোমরা মুক্ত-স্বাধীন।’ ‘হে কুরায়িশ সম্প্রদায়! আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জীবনধারা হতে জাহিলিয়া যুগের অহমিকা ও বংশ গৌরবের অবসান ঘটিয়েছেন। মানুষ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম হতে সৃষ্ট। আর হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম মাটি হতে সৃষ্ট।’১৯
উপসংহার
মানবতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। মদীনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল, পৃথিবীর অন্য কোন সমাজে এর নযীর নেই। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণে খুলাফায়ে রাশিদীন যে সমাজ ব্যবস্থা ক্বায়িম করেন, তা ছিল পুরোপুরি মানবতা ও ন্যায়-ইনসাফনির্ভর। ইসলাম প্রবর্তিত ন্যায়বিচার ব্যবস্থার কল্যাণ ও সুফল সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ ভোগ করে আসছে। সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী এবং রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে নুবূওয়াতের ধারাবাহিকতা সম্পন্ন হয়। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল যুলুমের অবসান ঘটিয়ে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ ক্বায়িম করা। তিনি উপলদ্ধি করেন, মানবিক আচরণ ও ন্যায়বিচার এমন এক নীতি, যার প্রয়োগ সুস্থ সমাজ সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। যে উদ্দেশ্যে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, ২৩ বছরের প্রাণান্তকর প্রয়াসে তিনি তা সফল ও সার্থকভাবে কার্যকর করেন। তাঁর অনুসৃত জীবন ব্যবস্থা মানুষের জীবন ও কর্মে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অুনপম আদর্শ। মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ছাড়া মানব জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই মানবিক মর্যাদাবোধ ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি অন্যের অধিকারের প্রতিও আন্তরিক হওয়া দরকার। যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবে কেউ যুলুমের শিকার না হয়। মানবতার বিপর্যয়ে ক্ষুব্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিতে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণে শুধু ইসলামী জীবনাদর্শ অনুসরণ ও অনুশীলনেই পৃথিবীকে শান্তি, সুন্দর ও প্রীতিময় করে তুলবে।
তথ্যসূত্র :
১. সূরাহ্ আল আহ্যাব : ২১।
২. মিশকাত, পৃ. ৪২৫।
৩. মিশকাত, পৃ. ৩৫৪; কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৮২।
৪. Dr. Majid Ali Khan, Muhammad, The Final Messenger, P. 337.
৫. ইব্ন সা‘দ, আত্ তাবাকাতুল কুবরা, ২খ., পৃ. ১৮৫; শিবলী নু‘মানী, সীরাতুন্ নাবী, ২খ., পৃ. ১৫৫।
৬. মিশকাত, হাদীস নম্বর ৩২৩৬ (১), ৭খ., পৃ. ১।
৭. সহীহ্ বুখারী, সহীহ্ মুসলিম, ইব্ন মাজাহ্, মুসনাদে আহ্মাদ।
৮. সহীহ্ বুখারী, সহীহ্ মুসলিম।
৯. আল-হায়সামী, কাশফুল আসতার, ২খ., পৃ. ৩৫।
১০. জালালউদ্দীন সায়ূতী, দুররুল মানসূর, ১খ., পৃ. ৩৯১; ইব্ন কাসীর, সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ্, ৪খ., ১৯৭৮, পৃ. ৩৯২।
১১. সূরাহ্ বানী ইসরাঈল : ৭০।
১২. মিশকাত আল্ মাসাবীহ্, ৯খ., পৃ. ১৪১।
১৩. আহমাদ ইব্ন হাম্বল, মুসনাদ, ৫খ., পৃ. ৪১১; জাহিয, আল্ বয়ান ওয়াত্ তিবইয়ান, ২খ., পৃ. ৩৩।
১৪. মিশকাত আল্ মাসাবীহ্, ৯খ., পৃ. ১২৮।
১৫. তিরমিযী, কিতাবুল জিহাদ, বাবু তা’আতিল ইমাম, ৪খ., পৃ. ২০৯।
১৬. সাইয়েদ আফগানী, আল্ ইসলাম আল্ মারাআত, পৃ. ১৯; মুহাম্মদ রশীদ রেযা, হুকুক আন্ নিসা ফিল ইসলাম, পৃ. ৬২।
১৭. জা‘মি ‘তিরমিযী, ৪খ., পৃ. ৩৬৬-৭; সুনানু আবূ দাউদ, ৫খ., পৃ. ৬১২।
১৮. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৬৫৭; নারী অধিকার প্রসঙ্গ।
১৯. ইব্ন হিশাম, আস্ সীরাতুন নাবাবিয়্যা, আল্ ইসতি’দাদ লিফাত্হি মাক্কাহ্, মা কালাহু আলাইহিস্ সালাম আ‘লা বাবিল কা‘বাহ্, ৫খ., পৃ. ৭৩।
লেখক : ইসলামী সাহিত্যিক, মানবাধিকার গবেষক, সুশাসন সংগঠক, zahurulanwar67@gmail.com