ওহাবী ও আহলে হাদীস

ওহাবী ও আহলে হাদীস

আসল ওহাবী ও আহলে হাদীস  একই মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
===========
অদৃশ্যের সংবাদাতা আমাদের আক্বা ও মাওলা সরকার-ই দু’জাহান সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইসলামের স্বচ্ছ উদ্যানে (সুন্নী দুনিয়ায়) ‘বাহাত্তর ফির্কারূপী’ যেসব জাহান্নামী আগাছা জন্মাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছেন তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওহাবী-খারেজী সম্প্রদায়। আর এ ওহাবী সম্প্রদায়ের নতুন নাম ও নব-সংস্করণ হচ্ছে ‘আহলে হাদীস’। কারণ এ মহাভ্রান্ত ‘আহলে হাদীস’-এর আক্বীদা বা তথাকথিত ধর্ম বিশ্বাস ও অপকর্মগুলো ওহাবীসম্প্রদায়ের মূল গুরু ‘মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব নজদী’রই অনুরূপ। মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলা, তাঁর মহান হাবীব ও আহলে বায়ত এবং আউলিয়া-ই কেরামের মানহানি ইত্যাদি তো আছেই, মাযহাব, ইজতিহাদ ও তাক্বলীদের গুরুত্বকে অস্বীকার বরং এর বিরুদ্ধে চরম বেয়াদবী প্রদর্শন ইত্যাদির ধারনা দেখলে সবাই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ‘আহলে হাদীস’ নামের এ ভ্রান্ত সম্প্রদায় ইবনে ওয়াহ্হাব নজদীর অন্যতম পরম স্বপ্ন (মাযহাবের বিরোধিতা) বাস্তবায়নের জন্যই এখন আদাজল খেয়ে লেগেছে।
ওদিকে পবিত্র আরব-ভূমিতে অপবিত্র-গোস্তাখ সালাফী-ওহাবীরা ইবনে ওয়াহ্হাবের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণা ও অপকর্মগুলো বাস্তবায়নের সাথে সাথে মাযহাব-বিরোধী মারাত্মক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, আর এদিকে (পাক-বাংলা-ভারত উপমহাদেশ ইত্যাদিতে) ওই ‘কুখ্যাত’ ওহাবীদের একটি অংশকে তথাকথিত ‘আহলে হাদীস’ নাম দিয়ে লেলিয়ে দিয়ে তাদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। এখন বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর পবিত্র ঘর মসজিদ থেকে আরম্ভ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও লোকালয় পর্যন্ত এ ভ্রান্ত সম্প্রদায়টার অশুভ পদচারণা ও অপকর্মতৎপরতায় মুসলিম সমাজ অতীষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে; তাদের অপপ্রচার ও নানা লোভ-লালসার শিকার হয়ে মহামূল্যবান ঈমান ও মুক্তির অন্যতম উপায় নেক আমলকে দ্রুত বিনষ্ট করতে চলেছে কিছু সরলপ্রাণ কিংবা বদনসীব মুসলিম-জনতা। এসব কারণে এদের মুখোশ ঊন্মোচনের নিমিত্তেই এ লেখা।
ওহাবী ও আহলে হাদীসের গোড়ার কথা
মিশকাত শরীফ: ২য় খন্ড: ইয়ামন ও শাম (সিরিয়া) সম্পর্কে আলোচনা শীর্ষক অধ্যায়ে সহীহ্ বোখারী শরীফের বরাতে বর্ণিত, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, একদিন হুযূর-ই আক্রাম বিশ্ব জগতের জন্য রহমত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রহমতের সমুদ্রে ঢেউ খেললো। তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার মহান দরবারে হাত মুবারক তুলে দো‘আ করে যাচ্ছিলেন, ‘আল্লাহুম্মা বা-রিক লানা ফী শা-মিনা’ [হে আল্লাহ্! আমাদের শাম (সিরিয়া)’-এ বরকত দাও], আল্লাহুম্মা বা-রিক লানা ফী ইয়ামনিনা। [হে আল্লাহ্! আমাদের ইয়ামনে বরকত দাও]। উপস্থিতদের থেকে একজন আরয করলেন, ওয়া ফী নজদিনা ইয়া রাসূলাল্লাহ্ [হে আল্লাহর রসূল! আমাদের নজদের জন্যও দো‘আ করুন। যেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাতে বরকত দান করুন। তারপরও হুযূর-ই আক্রাম ওই দো‘আ করলেন। দো‘আয় শাম ও ইয়ামনের কথা উল্লেখ করেছেন, নজদের নাম নেননি। তাঁরা আবারও হুযূর-ই আক্রামের কৃপাদৃষ্টি কামনা করে আরয করলেন, ওয়াফী নজদিনা’ (হুযূর, অনুগ্রহ করে এ দো‘আও করুন যেন, আল্লাহ্ তা‘আলা নজদেও বরকত নাযিল করেন)। মোটকথা, তিনবার ইয়ামন ও শামের জন্য দো‘আ করেছেন; কিন্তু বারংবার কৃপাদৃষ্টি আকৃষ্ট করার চেষ্টা সত্ত্বেও নজদের নাম নিলেন না; নজদের জন্য দো‘আ করেননি বরং এরপর এরশাদ করেছেন ‘হুনা-কায্ যালা-যিলু ওয়াল ফিতানু ওয়া বিহা-ইয়াত্বলা‘উ ক্বরনুশ্ শয়তান’। (অর্থাৎ আমি ওই আদি বঞ্চিত ভূ-খন্ডের জন্য কীভাবে দো‘আ করবো? ওখানে তো ভূ-কম্পন ও ফিৎনাদি সংঘটিত হবে। আর ওখানে শয়তানী দলসমূহের সৃষ্টি হবে)। এ থেকে বুঝা গেলো যে, হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দৃষ্টিতে দাজ্জালের ফিৎনার পর নজদের (ওহাবী) ফিৎনাও ছিলো। এ কারণে তিনি তাদের সম্পর্কেও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া, মিশকাত শরীফ: ১ম খন্ড: কিতাবুল ক্বিয়াস-এ, মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফের: ‘মু’জিযাত শীর্ষক অধ্যায়ে’; ফাতাওয়া-ই শামীর ‘বুগাত’ (বিদ্রোহী) শীর্ষক অধ্যায়ে এবং ‘সায়ফুল জব্বার’ ইত্যাদিতে এ ওহাবী সম্প্রদায়ের পরিচয়, তাদের নিষ্ঠুরতা ও নানা ধরনের ফিৎনা ছড়ানো ইত্যাদির বর্ণনা বিশদভাবে দেওয়া হয়েছে।
এ উপমহাদেশে ওই ওহাবীদেরই প্রধান ঘাঁটি হচ্ছে দেওবন্দ মাদরাসা। হাদীস শরীফের ‘ক্বরনুশ্ শয়তান’ (শয়তানের শিং বা দল)-এর উর্দু অনুবাদও হয় ‘দেওবন্দ’। (‘দেও’ মানে শয়তান এবং ‘বন্দ’ মানে দল বা অনুসারী।) ওহাবী ও দেওবন্দী-এ উভয়ের আক্বীদা হুবহু এক, আমলে বাহ্যিকভাবে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও উভয়ে ইবনে ওয়াহ্হাব নজদীকে ভাল মনে করে, এমনকি এ দেওবন্দীরা ইবনে ওয়াহ্হাবের ভ্রান্ত আক্বীদাগুলো প্রতিষ্ঠার কাজেই আত্মনিয়োগ করে আসছে। দেওবন্দীদের পেশোয়া মৌং রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী তার ‘ফাতাওয়া-ই রশীদিয়া’র ১ম খন্ডে: তাক্বলীদ পর্বে (পৃ. ১১৯) লিখেছেন, ‘‘মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব -এর অনুসারীদেরকে ‘ওহাবী’ বলা হয়। তার আক্বাইদ উত্তম ছিলো। তার মাযহাব ছিলো হাম্বলী। অবশ্য তার মেজাজে কঠোরতা ছিলো। তার অনুসারীরা ভালো লোক; কিন্তু যারা সীমা লংঘন করেছে তাদের মধ্যে বিপর্যয় (ফ্যাসাদ) এসে গেছে। আক্বাইদ সবার এক ও অভিন্ন। আমলে ভিন্নতর-হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী ও হাম্বলী।’’
হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর শানে গোস্তাখী ও মান-হানিতে ওহাবী-দেওবন্দী মতবাদের কতিপয় নেতা ও তাদের লিখিত চরম বিভ্রািন্তপূর্ণ পুস্তকাবলী হচ্ছে-
(১) মৌলভী আশরাফ আলী থানভী ও তার হিফযুল ঈমান, এতে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর ইলমকে চতুষ্পদ পশুর ইলমের মতো বলা হয়েছে।
(২) মৌং খলীল আহমদ আম্বেটভী ও তার পুস্তক ‘বারাহীন-ই ক্বাত্বি‘আহ্’। এতে মৌলভী খলীল দেওবন্দী শয়তান ও মালাকুল মওতের জ্ঞানকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞান অপেক্ষা বেশী বলেছে।
(৩) মৌং ইসমাঈল দেহলভী ও তার পুস্তক ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ ও ‘সেরাতে মুস্তাক্বীম’। মৌলভী ইসমাঈল নামাযে হুযূর-ই আক্রাম (আলায়হ্সি সালাতু ওয়াস্ সালাম)-এর খেয়াল আসাকে গরু-গাধার খেয়াল থেকেও মন্দতর লিখেছে।
(৪) মৌলভী কাসেম নানূতভী ও তার ‘তাহযীরুন্নাস’। নানূতভী এতে ‘খাতামুন নবিয়্যীন’ মানে ‘আখেরী নবী’ ‘মানতে অস্বীকার করেছে। আর একথা বলার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে যে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর পর যদি আরো নবী এসে যায়, তবুও ‘খাতামিয়াত’ (হুযূর-ই আক্রামের ‘শেষ নবী’ হওয়া)’র কোন ক্ষতি হবে না। তার মতে, ‘খাতাম’ মানে ‘আসলী নবী’ আর অন্য নবী হবে ‘ছায়ানবী’। ভন্ডনবী গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী একথাই বলেছে, ‘‘আমি বরোযী নবী।’’ মোটকথা, মির্যা গোলাম আহমদ তার ভন্ড নুবূয়তের দাবীতে মৌলভী কাসেম নানূতবীর বিশ্বস্ত শীর্ষই হলো। উল্লেখ্য, বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে কওমী-হেফাযতীরা ওই নজদী-ওহাবীদেরই একান্ত অনুসারী। ঢাকার লালবাগ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, বাবুনগর, পটিয়া, জিরি ইত্যাদিতে অবস্থিত ওহাবী মাদরাসাগুলো ওই নজদী-দেওবন্দীদের আক্বাইদ ও আমলকেই এদেশে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দুঃখজনকভাবে তৎপরত রয়েছে। বর্তমানে তো একই আদলে আরো মাদরাসা, নূরানী মাদরাসা, ইসলামী কিন্ডার গার্টেন, হেফযখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় আশঙ্কাজনকভাবে তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
‘আহলে হাদীস’ (লা-মাযহাবী)
এ সম্প্রদায়টাও উক্ত ওহাবী-নজদীদেরই একটা অংশ। ওহাবী সম্প্রদায়ের প্রবক্তা যেমন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব নজদী, ‘আহলে হাদীস’ সম্প্রদায়টার গোড়ায়ও রয়েছে ওই একই ব্যক্তি। এমনকি এতদিন ইবনে ওয়াহ্হাব নজদীর যে ভ্রান্ত আক্বীদা ও অ-ইসলামী কাজটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি, সেটাও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে- আরবে সালাফী-ওহাবীরা আর এ উপমহাদেশে ‘আহলে হাদীস’ (লা-মাযহাবী) সম্প্রদায়। এক্ষেত্রে আসল ওহাবীরাই নামের হেরফের করে, মূল ওহাবী-মতবাদকে ঠিক রেখে ‘মাযহাব অস্বীকার’ ও তদ্সম্পর্কিত বিভ্রান্তিপূর্ণ কার্যাদির পরিবর্দ্ধন করা হয়েছে মাত্র।
এভাবে বললে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে যে, ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব নজদী তার ওহাবী মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার কাজ যখন থেকে আরম্ভ করেছিলো, তখন থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ তার সব বাতিল আক্বীদা ও সুন্নী মতাদর্শ বিরোধী কর্মকান্ড মুসলিম সমাজে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এজন্য তাদেরকে আর্থিক যোগান ও যাবতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগী দেওয়া হচ্ছে। সমমনা ধনাঢ্য ও ক্ষমতাসীন লোকদের পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য, ইবনে ওয়াহ্হাব নজদীই ছিলো মূলত: ‘লা-মাযহাবী’। মাযহাব ও মাযহাবের (হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী ও হাম্বলী) ইমামগণের অনুসরণে সে বিশ্বাসী ছিলো না। পুরানা ‘খারেজী সম্প্রদায়’ ও ইবনে তাইমিয়ার অনুসরণে তাদের উদ্ভাবিত বাতিল আক্বীদা ও আমলগুলোরই নতুন সংস্করণ হলো এ ইবনে ওয়াহ্হাবের মাধ্যমে। এ ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য নিয়োগ করা হলো প্রচূর এজেন্ট ও প্রচারক। প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রচারক ও এজেন্টরা বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সমসাময়িক অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে তাদের এ প্রচারণা চালিয়ে যায়। আর এক পর্যায়ে এসে যখন সৌদী আরবে একচ্ছত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ মতবাদী লোকের সংখ্যা কিছুটা বাড়লো, তখনই তার অবশিষ্ট কাজটি (মাযহাবকে অস্বীকার করা এবং মাযহাব বিরোধী কর্মতৎপরতা) ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হয়। সৌদী আরবে ও পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর ওহাবীদের নাম দেওয়া হয় ‘সালাফী’ আর এ উপমহাদেশের ওহাবীদের একটি অংশকে ‘আহলে হাদীস’ নাম দিয়ে এ মতবাদ প্রচারের জন্য নিয়োগ করা হলো। ওদিকে সালাফীরা মুসলমানদেরকে, এমনকি সারা বিশ্বের হজ্ব ও ওমরাহ্ এবং যিয়ারতকারীদের মধ্যে সরকারীভাবে মাযহাবের বিরোধিতাসহ ওহাবিয়াৎ প্রচার করা হচ্ছে আর এদিকে, বিশেষত এ উপমহাদেশে ‘আহলে হাদীস’ (লা-মাযহাবী, গায়র মুক্বাল্লিদ) সম্প্রদায়টা, তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় একই ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুরু থেকেই বিশ্বের মুসলমানগণ সুন্নী আক্বীদায় বিশ্বাসী। সুন্নী মতাদর্শই ইসলামের একমাত্র সঠিক রূপরেখা। এ ‘আহলে সুন্নাতের’ আদর্শে রয়েছে কোন না কোন মাযহাবের একজন ইমামের অনুসরণ করা। এটা পবিত্র ক্বোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা’ ও ক্বিয়াস অনুসারে ‘মুজতাহিদ’-এর মর্যাদায় পৌঁছেনি এমন সকল মুসলমানের উপর ‘ওয়াজিব’। ইসলামের পরিভাষায় মাযহাবের এ অনুসরণকে বলা হয়, ‘তাক্বলীদ’ আর যিনি এ ওয়াজিব কাজটা মানেন ও সম্পন্ন করেন, তিনি হলেন ‘মুক্বাল্লিদ’। আর ইসলামের মূল দলীলগুলো থেকে মাসআলা-মাসাইল (সমাধান) বের করা ‘উসূল-ফিক্বহ্’ অনুসারে যোগ্যতা সম্মত ইমামগণ হলেন ‘মুজতাহিদ’ আর তাঁদের এ গবেষণাকর্ম হচ্ছে ‘ইজতিহাদ’। ইসলামী শরীয়ত অনুসারে, মুজাহিদের জন্য ‘ইজতিহাদ’ করা যেমন ওয়াজিব বা অপরিহার্য, তেমনি ‘মুক্বাল্লিদ’ পর্যায়ের মুসলমানদের উপর ‘তাক্বলীদ’ (বা হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবগুলো থেকে যেকোন একটির অনুসরণ) করাও ওয়াজিব। এ কারণে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বিশ্বের মুসলমানগণ কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী হয়ে আসছেন।
উল্লেখ্য যে, এ ইবনে ওয়াহ্হাব নজদীর প্রচারকরা যখন মাযহাব-বিরোধী প্রচারণাও আরম্ভ করে, তখন তারা চতুর্দিকে থেকে বাধার সম্মুখীন হতে থাকে। তখন তারা ‘মাযহাব’ মান্য করার বিষয়টি শিথিল করে ওহাবী মতবাদের অন্যান্য বিষয়গুলো (বিশেষত ওহাবী আক্বীদা)’র প্রচারে প্রতি জোর দিতে থাকে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে, যেসব অঞ্চলে যে মাযহাবের অনুসারী বেশী ওই অঞ্চলের ওহাবীরা ওই মাযহাবের অনুসারী বলে পরিচিত। যেমন- মদীনা শরীফের ওহাবীরা মালেকী, ফিলিস্তীন, সিরিয়া ও ইরাক ইত্যাদির ওহাবীরা শাফে‘ঈ, পাক-ভারত-বাংলাদেশের ওহাবীরা হানাফী এবং নজদের ওহাবীরা হাম্বলী ইত্যাদি। আল্লামা শামী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘ফাতাওয়া-ই শামী’: ৩য় খন্ড: বুগাত (বিদ্রোহীগণ) এর বর্ণনা শীর্ষক অধ্যায়ে লিখেছেন-
‘‘যেমন আমাদের যুগে ‘ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাবের অনুসারীদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনা ঘটে। এসব লোক নজদ থেকে বের হয়েছে। এক সময় মক্কা ও মদীনা শরীফের উপর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে নেয়। তখন তারা নিজেদেরকে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী বলে পরিচয় দিতে থাকে। কিন্তু তাদের এ আক্বীদা (বিশ্বাস) ছিলো যে, শুধু তারাই মুসলমান, আর যারা তাদের আক্বীদার পরিপন্থী (বিরোধী) তারা মুশরিক। এ কারণে তারা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের’ লোকদের হত্যাকে পর্যন্ত জায়েয বলে মনে করতো। সুতরাং তারা তাঁদের (আহলে সুন্নাত) আলিমদের শহীদ করলো। শেষ পর্যন্ত (তখনকার সময়ে) আল্লাহ্ তা‘আলা ওহাবীদের দাপটকে দমিত করে দিয়েছিলেন। তাদের শহরগুলোকে বিরান করে দিয়েছেন। ইসলামী সৈন্যবাহিনীকে বিজয় দান করেছিলেন। এ ঘটনা ঘটেছিলো ১২৩৩ হিজরিতে।’’
‘সাইফুল জাব্বার’-এ তখনকার সময়ে ওহাবীদের, মক্কা, মদীনা শরীফ এবং এতদ্ঞ্চলের পবিত্র ভূমিগুলোর উপর তাদের তান্ডবের বর্ণনা বিস্তারিতভাবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় যে, ইতিহাসের এক পর্যায়ে এসে এ ওহাবীরা গোটা হেজাযভূমিতে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং রাজকীয় ক্ষমতা ও অর্থ ব্যবহার করে এ ওহাবী আক্বীদা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখে। এখনো আরব ও অনারব বিশ্বে তাদের এ অপচেষ্টা চলে আসছে।
বাকী রইলো, পাক-ভারত বাংলাদেশ (উপমহাদেশ)-এ এ ওহাবী মতবাদের অনুপ্রবেশ ও শেষ পর্যন্ত আহলে হাদীসের আত্মপ্রকাশ। সৈয়্যদ আহমদ বেরলভী এদেশে ওহাবী মতবাদ আমদানীতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষী দেয়। ‘আশ-শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব’ নামক পুস্তক (কৃত. আহমদ ইবনে হাজর: কাতার: মক্কা মুকাররমাহয় মুদ্রিত ও বিনামূল্যে প্রচারিত-১৩৯৫হি.), পৃ. ৭৮-৭৯ তে একথা স্পষ্ট ভাষায় লেখা হয়েছে। এ সৈয়্যদ আহমদ বেরলভীর প্রধান সহযোগী ছিলো মৌং ইসমাঈল দেহলভী। সে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব নজদীর ‘কিতাবুত্তাওহীদ’-এর সারসংক্ষেপ উর্দুতে অনুবাদ করে ‘তাক্ভিয়াতুল ঈমান’ নামে এ উপমহাদেশে প্রকাশ ও প্রচার করে। বিশেষতঃ আক্বীদাগত বিভ্রান্তি ছড়ানোর কারণে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী পাঠানগণ তাকে হত্যা করেছিলেন। [সূত্র. আন্ওয়ার-ই আফতাব-ই সদাক্বত] ওহাবীরা তাকে ‘শহীদ’ বলে। আর একথা বলে প্রচার করে যে, তাকে নাকি শিখরা হত্যা করেছে।
আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত আলায়হির রাহমাহ্ লিখেছেন-
ওয়হ্ ওয়াহ্হাবিয়াহ্ নে জিসে দিয়া হ্যায় লক্বব শহীদ ও যবীহ্ কা,
ওয়হ্ শহীদে লায়লা-ই নজদ থা, ওয়হ্ যবীহে তী-সে খেয়ার হ্যায়।
অর্থ: ওই ওহাবীরা যাকে ‘শহীদ’ ও ‘যবেহ্কৃত’ উপাধি দিয়েছে,
সে তো আসলে নজদের লায়লার জন্যই মজনু রূপী শহীদ ছিলো;
তাকে আল্লাহর নেক বান্দারাই হত্যা করেছেন।
এমনকি তার লাশ পর্যন্ত ওইসব খাঁটি মুসলমানগণ গায়ব করে ফেলেছেন। এজন্য তার কবরের কোন হদীস পাওয়া যায়না।
এ ইসমাঈল দেহলভীর অনুসারীরা পরবর্তীতে দু’ভাগে বিভক্ত হয়-
এক. তারা নিজেদেরকে ‘হানাফী’ বলে পরিচয় দেয়। নামায-রোযা আমাদের মতো সম্পন্ন করে। তাদেরকে ‘গোলাবী-ওহাবী-দেওবন্দী’ বলা হয়। হাদীসে পাকের পবিত্র ভাষায়, ‘ক্বরনুশ শয়তান’-এর উর্দু অনুবাদ করলেও ‘দেওবন্দ’ হয়।
দুই. তারা ইমামগণের ‘তাক্বলীদ’-এর মতো একান্ত জরুরী বিষয়টিকে অস্বীকার করে। তাদেরকে ‘গায়র মুক্বাল্লিদ ওহাবী’ বলা হয়। পরবর্তীতে তারা ‘আহলে হাদীস’ নাম ধারণ করেছে। আমি এর পক্ষে একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করতে চাই। মাওলানা আবুল হামিদ মুহাম্মদ যিয়াউল্লাহ্ ক্বাদেরী (সিয়ালকোট, পাকিস্তান) তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘ওহাবী মাযহাবের হাক্বীক্বত’-এ ‘মুহাম্মদ হোসেন বাটালভীর ইংরেজ প্রীতি’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘‘ওহাবী-নজদীদের নেতা সৈয়্যদ আহমদ বেরলভী, মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী (মাক্বতূল), মিঞা নযীর হোসেন দেহলভী, নবাব সিদ্দীক্ব হাসান ভূপালী, আবদুল্লাহ্ গযনভী ও সিদ্দীক্ব হাসান পেশোয়ারীর পর ওহাবীদের অতি সম্মানিত ব্যক্তি হলেন- মুহাম্মদ হোসেন সাহেব বাটালভী। তিনি বলেছেন, ‘‘ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা ওয়াজিব।’’ তিনি লিখেছেন, ‘‘ইংরেজগণও বাটালভীর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলো। বাটালভীকে জায়গীর দিয়েছে, পুরস্কারও দিয়েছে। বাটালভীও অতিরিক্ত সুযোগ মনে করে নিজেদের জন্য ‘ওহাবী’র পরিবর্তে ‘আহলে হাদীস’ নামের প্রচলন ও প্রসিদ্ধ করিয়েছে। তারা দ¯ুÍরমত বৃটিশ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততার ঘোষণা সরকারী রেকর্ডপত্রে তাদের পরিচয় ‘ওহাবী’র পরিবর্তে ‘আহলে হাদীস’ লিপিবদ্ধ করানোর নির্দেশ জারী করিয়েছিলেন।’’ মুহাম্মদ আইয়ুব ক্বাদেরী লিখেছেন, ‘‘তিনি/তারা ‘জমায়াতে আহলে হাদীসের কর্মকর্তাদের সইকৃত একটি দরখাস্ত পাঞ্জাবের ল্যাফটেন্যান্ট গভর্ণরের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের নিকট পাঠিয়েছিলো। ওই দরখাস্তকারীদের তালিকার শীর্ষে মিঞা নযীর হোসেনের দস্তখতও ছিলো। পাঞ্জাবের গভর্ণর ওই দরখাস্তে তার সুপারিশনামা সহকারে গভর্ণম্যান্ট অফ ইন্ডিয়ার নিকট পাঠিয়েছিলেন। ওখান থেকে দস্তুর মত মঞ্জুর হয়ে এসে গিয়েছিলো- ‘‘আগামীতে ‘ওহাবী’ শব্দের পরিবর্তে ‘আহলে হাদীস’ ব্যবহার করা হবে।’’ [সূত্র. জঙ্গে আযাদী-১৮৫৭, কৃত. আইয়ূব ক্বাদেরী) দরখাস্তটার মঞ্জুরী ইংরেজী ভাষায় নি¤েœ প্রদত্ত হলো-
From:
          W.M. Young Esque
          Secretary to the Government of Punjub.
 To,
          Moulvi Abu Said Mohammad Hassain
          Editor of the Ashaat-ul- Sunnah,
          Lahore.
           D/lahore 19th January, 1887.
 Sir,
          In reply to your letter No. 195 of the 12 th May last, asking that, the use ot the expression `Wahabi’ in reference to member of the community which you claim to represent may be prohibited in government orders.
I am directed to forward the enclosed copy of a letter no 1758 dated the 3rd from the afficiating secretary to the government of India, in the Home Department’s the discontinuance of the use of the term Wahabi in official correspondence.
                                                                                               (Singned)
অর্থাৎ মি. ডব্লিউ এম. ইয়াং বাহাদুর, সেক্রেটারী, পাঞ্জাব সরকার,
সূত্র. চিঠি নং ১৩৭, তারিখ ১৯ জানুয়ারী, ১৮৮৭ইং,
প্রাপ্রক মৌলভী আবূ সাঈদ মুহাম্মদ হোসেন সাহেব,
সম্পাদক, ইশা-‘আতুস্ সুন্নাহ্, লাহোর, চিঠি নং ১৯৫, তারিখ ১২ মে, ১৮৮৬ইংরেজী এর জবাবে-
এ মর্মে জানানো হচ্ছে যে, আপনার দরখাস্ত অনুসারে ‘ওহাবী’ শব্দটি এ জামা‘আতের জন্য সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহার করা হবেনা।’’ [সংক্ষেপিত]
উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, ‘আহলে হাদীস’ সম্প্রদায়টা আসলে ওহাবী। কিন্তু এ পরিচয় বহনে নানা অসুবিধা এড়ানোর জন্য কিংবা মুসলমানদেরকে অন্যভাবে ধোঁকা দেওয়ার জন্য তারা এর বিকল্প নাম ‘আহলে হাদীস’ গ্রহণ করেছে। তদুপরি, তাদের কর্মকান্ড ও মুখের দাবী থেকে বুঝা যায় যে, তারা মাযহাবের গুরুত্বকে অস্বীকার করে সরাসরি ‘হাদীস’ থেকে শরীয়তের বিধানাবলী ও সমাধান বের করে আমল করতে চায়। অথচ, তাদের মধ্যে না এর যোগ্যতা আছে, না আছে কোন সদুদ্দেশ্য; বরং ওহাবী মতবাদের প্রবর্তক ইবনে ওহাবী নজদী মাযহাবকে অস্বীকার করে ইতোপূর্বে মুসলিম সমাজে যেই বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিলো এবং প্রকারান্তরে সেটাও বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখেছিলো ওই বিভ্রান্তিটাকেই প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা এহেন গর্হিত পথটা বেছে নিয়েছে। অথচ পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ তা‘আলার স্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে- ‘‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, অনুগত্য করো রসূলের এবং ‘উলিল আমর’ (তথা মাযহাবের ইমামদের)।’’ [৪:৫৯]
‘‘কাজেই হে লোকেরা, ইলমসম্পন্নদের জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমাদের ইলম না থাকে।’’ [২১: ৭] তাছাড়া, দারেমী শরীফে ‘বাবুল ইক্বতিদা বিল ইলমে’ বর্ণিত হয়েছে- ‘‘আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য রসূলের এবং নিজেদের মধ্য থেকে নির্দেশদাতাদের।’’ হযরত আত্বা বলেন, আয়াতে ‘উলিল আমর’ (নির্দেশ দাতা) হলেন- সম্মানিত জ্ঞানী ও ফিক্বহবিদগণ। তাছাড়া, ‘তাফসীর-ই সাভী’ শরীফে ‘ওয়ায্কুর রাব্বাকা ইযা নাসী-তা’-এর তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘চার মাযহাব ব্যতীত অন্য কারো ‘তাক্লীদ’ (অনুসরণ) করা বৈধ নয়; যদিও তা হয় সাহাবা-ই কেরামের অভিমত, সহীহ্ হাদীস ও আয়াতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যে ব্যক্তি এ চার মাযহাব বহির্ভুত, সে নিজেও পথভ্রষ্ট, অপরকেও পথভ্রষ্টকারী। কারণ ক্বোরআন ও হাদীসের নিছক জাহেরী অর্থ লওয়া কুফরের মূল। এতদ্ব্যতীত ক্বোরআন, সুন্নাহ্ ও ফিক্বহর যথেষ্ট প্রমাণ এ মর্মে রয়েছে যে, তাক্বলীদ করা (মাযহাবের অনুসরণ করা) ‘মুক্বাল্লিদ’ পর্যায়ের মুসলমানদের উপর ওয়াজিব বা অপরিহার্য। এর ব্যতিক্রম করা জঘন্য গোমরাহী।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এ লা-মাযহাবীরা ইসলামী বিধানাবলীতে যেসব নতুন কাজ উদ্ভাবন করেছে, সেগুলোর অধিকাংশই হানাফী মাযহাবের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ মাযহাবগুলোর মধ্যে হানাফী মাযহাবই শ্রেষ্ঠ। হানাফী মাযহাবের ইমাম হলেন ইমাম-ই আ’যম। হানাফী মাযহাবের দলীলগুলো সর্বাধিক মজবুত। সর্বোপরি, হানাফী মাযহাবের অনুসারীও সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী। (বিশ্বের অর্দ্ধেক কিংবা অর্দ্ধেকেরও বেশী মুসলমান হানাফী।) এসব কারণে, সালাফী ও আহলে হাদীস তথা লা-মাযহাবীরা তাদের বিরোধিতার সর্বোগ্রে লক্ষ্যবস্তু করেছে ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা ও হানাফী মাযহাবকে। তারা অন্যান্য ইমামের তুলনায় ইমাম আ’যমের শানে বেশী অশালীনতা প্রদর্শন করে, আর হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ ইমাম-ই আ’যমের শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। আর ইমাম আ’যম ও অন্যান্য ইমামগণের শানে বেয়াদবী করা বে-দ্বীনী বৈ-কিছুই নয়। আরো লক্ষ্যণীয় যে, তাদের হানাফী মাযহাব-বিরোধী অনেক কাজ শাফে‘ঈ, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অথচ তারা হানাফী মাযহাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে যে অন্য মাযহাবের প্রকারান্তরে অনুসরণ করছে, তা মুখে বলে না। তাদের আরেক কৌশল লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, তারা কথায় কথায় ইমাম বোখারীর বোখারী শরীফ ও তাঁর কিছু কিছু লেখনীর বরাত দেয়। অথচ, ইমাম বোখারী হয়তো শাফে‘ঈ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন অথবা তিনি নিজে একজন মুজতাহিদ ছিলেন। আরো মজার বিষয় যে, অনেক বিষয়ে হানাফী মাযহাবের পক্ষে খোদ্ বোখারী শরীফে সহীহ্ হাদীস রয়েছে। সুতরাং হানাফী কিংবা অন্য কোন মাযহাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে ইমাম বোখারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই। মর্যাদাগতভাবেও ইমাম-ই আ’যম হলেন ইমাম বোখারীর দাদা-ওস্তাদ। এ প্রসঙ্গে যদি লা-মাযহাবীরা এ প্রশ্ন করে যে, ‘তা-ই যদি হয়, তাহলে ইমাম বোখারী ইমাম আযমের বর্ণিত হাদীস কেন বোখারী শরীফে উল্লেখ করেন নি?’ এর জবাব হচ্ছে- ইমাম বোখারী ইমাম মুসলিমেরও কোন হাদীস তাতে আনেননি। এতে তো মুসলিম শরীফের বিশুদ্ধতার কোন ক্ষতি হয়নি। কি কারণে ইমাম বোখারী তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেননি, তাও হাদীস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সেগুলো উল্লেখ করে কলেবর বৃদ্ধি করার কোন যুক্তি নেই।
এখন দেখা যাক আহলে হাদীসের উদ্ভাবিত হানাফী-মাযহাব বিরোধী কিছু কর্মকান্ড। বিশেষত নামাযের ক্ষেত্রে তাদের ব্যতিক্রমধর্মী ও অমূলক কার্যাদি বেশী পরিলক্ষিত হয়। যেমন- নামাযে দাঁড়াতে গিয়ে দু’পায়ের মধ্যখানে অস্বাভাবিক ফাঁক করে দাঁড়ায় সালাফীও লা-মাযহাবীরা; অথচ হানাফী মাযহাব মতে দাঁড়াতে হয় দু’পায়ের মাঝখানে মাত্র চার আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রেখে।
তাকবীর-ই তাহরীমাহ্ বলার সময়, হানাফী মাযহাব মতে, পুরুষ তার দু’হাত তুলবে তার দু’কান পর্যন্ত আর নারী তার দু’কাধ পর্যন্ত। তারপর পুরুষ তার দু’হাত বাঁধবে তার নাভীর নিচে, আর নারী তার বুকের উপর। কিন্তু সালাফী ও আহলে হাদীস উভয় ক্ষেত্রে যথাক্রমে পুরুষকে বলে হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলতে, আর হাত বাঁধতে বুকের উপর। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে মেয়েদের মতো করতে বলে। অথচ উভয় ক্ষেত্রে হানাফীদের প্রমাণ-ই মজবুত, তাই হানাফী মাযহাব শ্রেষ্ঠতম। ইমাম সূরা ফাতিহা পড়ার পরক্ষণে মুক্তাদীগণ ‘আমীন’ বলবে নি¤œস্বরে। কিন্তু সালাফী ও আহলে হাদীস বলে উচ্চস্বরে। অথচ নি¤œস্বরে বলার পক্ষে দলীলগুলো অধিকতর শক্তিশালী। তারপর নামাযের বৈঠকগুলোতে পুরুষ বসবে বাম পা বিছিয়ে সেটার উপর আর ডান পা সোজা করে দাঁড় করিয়ে এমনভাবে বসবে যেন আঙ্গুলগুলো ক্বিবলার দিকে থাকে। আর মেয়েরা বসবে উভয় পা ডানদিকে বের করে দিয়ে। কিন্তু সালাফী ও তার দোসররা এ ক্ষেত্রেও পুরুষদেরকে মেয়েদের মতো করতে প্ররোচনা দেয়। এভাবে তারাবীহর নামায বিশ রাক্‘আত পড়া সুন্নাত-ই মুআক্কাদাহ্; কিন্তু এখানেও এসব ভ্রান্ত (সালাফী ও আহলে হাদীস) কাটসাঁট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তারা বলে আট রাক্‘আত পড়তে। অথচ সব দলীল বিশ রাক্‘আতের পক্ষে। আর আট রাক্‘আতের কোন দলীলই তারাভীহ্ নামাযের নয়; বরং অন্যান্য নামাযের। আর ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি; কিন্তু লা-মাযহাবী বলে আরো বেশী। বিতরের নামাযের বেলায়ও একই বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে লিপ্ত এসব গোমরাহ্ লোক। অথচ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, এসব ক’টি বিষয়েই হানাফীদের প্রমাণাদি অতি মজবুত ও যুক্তিযুক্ত। পক্ষান্তরে, সালাফীদের দোসর ‘আহলে হাদীস’-এর কর্ম, অপতৎপরতা ও অশালীনতাপূর্ণ আচরণ দেখলেই বুঝা যায় যে, তারা কোন না কোন ভ্রান্ত বরং মহাভ্রান্তের প্রদত্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নেমেছে। তাদের ধর্মীয় জ্ঞান না থাকা ও বিধর্মীদের বেশভূষা গ্রহণ করা সত্ত্বেও মাযহাবের বিরুদ্ধে বলা এবং ক্বোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত ও মুসলিম সমাজে সসম্মানে সমাদৃত ইমামদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মতো ধৃষ্ঠতা দেখলেই অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে সহজে অনুমান করা যায়। আরো জানা গেছে যে, বর্তমানে বাতিলদের নিয়োজিত এসব এজেন্ট দলবদ্ধ হয়ে মসজিদ ও ঈদগাহে যায় এবং পরিকল্পিতভাবে কয়েকজন করে একসাথে দাঁড়িয়ে নামাযে উক্ত সব অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে আ-মী-ন উচ্চস্বরে বলে, নির্লজ্জভাবে তাদের অশুভ উপস্থিতির ঘোষণা দেয়। মসজিদের বাইরে চনামুড়ি বিক্রেতা, মুচি-চামার ও টোকাইদেরকে টাকা দিয়ে মসজিদে নিয়ে যায় এবং নামাযে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাদেরকে নিয়োগ করে। এদের এসব টাকার উৎস কোথায় তা নিয়েও সচেতন মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। মোটকথা, এসব লা-মাযহাবী (সালাফী-আহলে হাদীস)-এর অশুভ পাঁয়তারায় গণ-মানুষ তীব্র অসন্তুষ্ট ও অতীষ্ঠ। এদের ব্যাপারে সমাজকে এখন থেকে সচেতন হওয়া জরুরী।
নি¤েœ অতি সংক্ষেপে কতিপয় মাসআলায় হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার প্রয়াস পাচ্ছি। বিস্তারিত ও প্রমাণ্যভাবে প্রায় সব মাসআলার হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে যাচ্ছি মাসিক তরজুমানে।
তাকবীর-ই তাহরীমায় পুরুষ কান পর্যন্ত হাত তুলবে
বোখারী মুসলিম, তাহাবী শরীফে মালেক বিন হুয়াইরিস থেকে বর্ণিত-
كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا كبر رفع يدىه حتى اذنيه وفى لفظ حتى يحاذى بهما فروع اذنتيه
অর্থাৎ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন তাকবীর বলতেন, তখন কান পর্যন্ত হাত তুলতেন। অপর বর্ণনা মতে কানের লতি পর্যন্ত হাত তুলতেন। এ ধরনের কানের লতি পর্যন্ত হাত তোলার ব্যাপারে আবূ দাঊদ শরীফের বারা ইবনে আযেব থেকে, মুসলিম শরীফে ওযাইল ইবনে হুজার থেকে বোখারী, আবূ দাঊদ ও নাসা‘ঈ শরীফে আবূ ক্বালাবাহ্ থেকে, ইমাম আহমদ, ইসহাক্ব ইবনে রাহওয়াহ্, দারে ক্বুতনী ও ত্বাহাভী বারা ইবনে আযেব থেকে, বায়হাক্বী তাঁর মুস্তাদরাকে আনাস ইবনে মালেক থেকে, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক বারা ইবনে আযেব থেকে, তাহাবভী আবূ হুমাইদ সা’দী থেকে ২০টি বর্ণনা এসেছে, যেগুলোর প্রত্যেকটিতে তাকবীরে তাহরীমার সময় কানের লতি পর্যন্ত হাত তোলার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আহলে হাদীস বলে দাবীদারগণ এতগুলো হাদিসের উপর আমল না করেও কিভাবে ‘আহলে হাদীস’ পরিচয় দেয় তাও ভাববার বিষয়।
উচ্চস্বরে আ-মীন বলা
সালাফী ও আহলেহাদীস মাগরিব এশা এবং ফজরের নামাযে ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ শেষ করলে উচ্চস্বরে আমিন বলে। এবং মুসলিম সমাজে নতুন আরেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। অথচ হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যে হাদিস দ্বারা আমীন উচ্চস্বরে বলার দলিল দিয়ে থাকেন সেখানে উচ্চস্বরে বলার কোন কথাই নেই। হাদিস পেশ করা হলো-
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন তোমাদের কেউ যখন নামাযে আমিন বলে, তখন ফেরেশতারা আসমানে আমীন বলেন। তখন একে অপরের আমীন এক সাথে হয়ে যায়, তখন আল্লাহ্ তার সমস্ত অতীত গোনাহ্ মাফ করে দেন। [বোখারী শরীফ: ৭৮১, মুসলিম শরীফ:৪১০] এ হাদীসে আমীন উচ্চস্বরে বলার কোন কথাই নেই। আর এটাই লা-মাযহাবীদের উচ্চস্বরে আমিন বলার দলিল। এভাবে আরো একটি হাদীসের দিকে দেখা যাক-
হযরত আবু হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নামায শেখাতে গিয়ে বলেছেন, তোমরা ইমামের আগে কোন কাজ করবে না। ইমাম তাকবীর বললে তোমরাও তাকবীর বলবে, ইমাম ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামীদাহ্ বললে তোমরা ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলো। ইমাম ওয়ালাদ্ব্ দ্বোয়া-ল্লীন’ বললে তোমরা আমীন বলো। [মুসলিম শরীফ, হাদিস নং ৪১৫]
এটা আহলে হাদীসের দলিল। অথচ এখানে আমীন বলার কথা থাকলেও উচ্চস্বরে বলার কোন ইঙ্গিত নেই।
এদের আরো একটি দলিল- তিরমিযী শরীফে হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘আমি রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে শুনেছি যে, তিনি ‘গাইরিল মাগদ্বূবে আলায়হিম ওয়ালাদ্ব্ দ্বোয়া-ল্লী-ন’ বলে আমীন বললেন, আওয়াজকে দীর্ঘ করে (মাদ্ পড়ে) আ-মীন।
দেখুন, হাদিসে এসেছে ‘মাদ্দাবিহা’ এর অর্থ মাদ্ করা, দীর্ঘ করা, আ-মী-ন টেনে টেনে পড়াকে ‘মাদ্’ বলে। যেমন ক্বারী সাহেবানগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করবেন। এটাকে উচ্চস্বরে অর্থ নেয়া অপব্যাখ্যার নামান্তর। অবশ্য আবূ দাঊদ শরীফে ‘রাফা‘আ বিহ্ াসাওতাহু’ এসেছে যার অর্থ আওয়াজকে উঁচু করা। এর জবাবে আলিমগণ বলেছেন, প্রথমত: এর পূর্বের মাদ্দা শব্দকে কোন বর্ণনাকারী হয়তো ‘রাফা‘আহ’ দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন। অথবা তিরমিযী ও আবূ দাঊদের রেওয়ায়েতে নামাযের কথা নেই। হতে পারে নামায ছাড়া সূরা ফাতিহা পড়লে সকলের ঐকমত হলো আমিন উচ্চ স্বরে পড়া। অথবা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুই, একবার তালিম দেয়ার জন্য উচ্চস্বরে পড়েছেন- এসব উত্তর এ জন্য দিতে হচ্ছে যেহেতু আমীন নি¤œস্বরে পড়ার পক্ষে সরাসরি হাদীস ‘নাস’ (দলীল) এসেছে। যেমন-
‘‘হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, তিনি একদা রাসূলে পাকের সাথে নামায পড়ছিলেন। তিনি যখন ওয়ালাদ্ব্ দ্বোয়া-ল্লীন’ এ পৌঁছলেন তখন চুপিচুপি আমীন বললেন। [আহমদ-৪র্থ খন্ড, পৃ. ৩১৬, আবূ দাঊদ-৯৩২,৯৩৩ পৃ., মোস্তাদরাক এর বর্ণনায় এসেছে ইয়াফিদ্বু বিহা সাওতাহু’ (আওয়াজকে নিচু করলেন), ২য় খন্ড, ২৫৩ পৃ. হাদীস নং-২৯১৩] নি¤œলিখিত হাদীসে ‘আমীন’সহ এরা ৪টি বিষয় নামাযে নি¤œস্বরে পড়ার সরাসরি উল্লেখ রয়েছেঃ
‘‘হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, ইমাম ৪টি বস্তু ছোট আওয়াজে পড়বে। এক. আউযুবিল্লাহ্, দুই. বিসমিল্লাহ্, ৩. আমিন, ৪. রাব্বানা লাকাল হামদ।
এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত হাকিমুল উম্মত আকায়ে নে’মত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী বদায়ূনী আশরাফী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লিখিত জা‘আল হক-এর ২য় খন্ড (৪৫-৫২) দেখার অনুরোধ রইল।
৩য় মতবিরোধ: বুকের উপর হাত বাধা
লা-মাযহাবিদের আরেকটি ব্যতিক্রম কাজ হলো বুকে হাত বাঁধা। নারী ও পুরুষের হাত বাঁধা নিয়ে ভিন্ন পদ্ধতি চলে আসছে। পুরুষ নাভীর নিচে হাত বাঁধবে আর মহিলা বুকের উপর। কিন্তু ‘আহলে হাদীস’ লা-মাযহাবীরা এই ভেদাভেদকে অমান্য করতঃ উভয়কে বুকের উপর হাত বাধার জন্য বাধ্য করে। এবং দলিল হিসেবে আবূ দাঊদ শরীফের একটি হাদীস পেশ করে। তা হচ্ছে- হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর বলেন, ‘‘আমি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে দেখেছি, তিনি বাম হাতের কব্জিকে ডান হাত দ্বারা ধরেছেন, আর নাভীর উপরে বেঁধেছেন।’’
সুতরাং বুঝা গেল নাভীর উপরে অর্থাৎ বুকে হাত বাধঁতে হবে। সম্মানিত পাঠক দেখুন যে হাদীস দ্বারা দলিল দেয়া হলো সে হাদিসে বুকের নাম গন্ধও নেই তা ছাড়া সে আবূ দাঊদ শরীফেই ওই হাদীসের পরপর আরো ব্যাখ্যা আছে তা কৌশলে গোপন করা হচ্ছে। যেমন- তাতে বর্ণিত হয়েছে-
‘‘এই নাভীর উপরে বাধা শব্দটি আবূ দাঊদের বর্ণনা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে সাঈদ ইবনে জুবাইর রেওয়ায়েত করেছেন। কিন্তু ওই একই সাহাবী থেকে আবূ জালাদ বর্ণনা করেছেন, ‘নাভীর নীচে’। আর হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, ‘নাভীর উপরের বর্ণনাটি’ শক্তিশালী নয়।
এতে গেলো নাভীর উপর হাত বাঁধার বর্ণনা। কিন্তু নিচে বাধাঁর ব্যাপারে প্রায় ১৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। তার ১টি নি¤েœ উল্লেখ করা হলো- ‘‘ওয়ায়েল ইবনে হুজর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, আমি স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি তিনি ডান হাতকে বাম হাতের উপরে নাভীর নিচে হাত বেঁধেছেন। ইবনে আবী শায়বা এই হাদীস বর্ণনা করে বলেছেন ওই হাদীসের সকল রাভী নির্ভরযোগ্য। [ইবনে আবী শায়বা ১ম খন্ড, ৩৯০ পৃ. তদরীবুর রাবী ১ম খন্ড, ১৮৮পৃ. আসারুস্ সুনান ১৭পৃ.]
চতুর্থতঃ রুকুর পূর্বে ও পরে হাত তোলা
এ সম্পর্কে নি¤েœর হাদিসটি দেখুন-
‘‘হযরত জাবের ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে তাশরীফ আনলেন এবং বললেন, আমার কি হলো যে, আমি তোমাদেরকে অবাধ্য ঘোড়ার লেজ তোলার মতো (বার বার) হাত তুলতে দেখছি? নামাজে শান্ত থাকো (এমনটি করো না)। [মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, ১৮১ পৃ. আবূ দাঊদ ১ম খন্ড, ১৪২পৃ.] এ হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে তাদেরকে রুকুর পূর্বে পরে হাত তুলতে নিষেধ। সুতরাং প্রমাণিত হলো ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’ সুন্নত নয়; বরং মানসূখ বা রহিত।
হযরত আলকামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একদিন আমাদেরকে বললেন, আমি তোমাদেরকে রাসূলাল্লাহর নামায পড়ে দেখাব? তখন তিনি নামায শুরু করে দিলেন। যে নামাযে তিনি শুধুমাত্র একবারই (তাহরীমাতে) হাত তুলেছেন। [আবূ দাঊদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১০৯, তিরমিযী ২য় খন্ড, পৃ. ৪০, নাসা‘ঈ ১ম খন্ড, পৃ. ১৯৫] ইমাম তিরমিযী এ হাদিসকে ‘হাসান’ বলেছেন। সাহাবী তাবেয়ীগণ এ হাদিস এর উপর আমল করেছেন। এটাই সুফিয়ান সাওরী এবং কুফাবাসীর মতামত। এ হাদীসের সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।
মোটকথা চার খলিফা থেকে সহীহ্ সনদে হাত তোলার কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। যদি হাত তোলা সুন্নাত হতো, তাহলে অবশ্যই চার খলিফা এর উপর আমল করতেন। বুঝা গেল এটা সুন্নাত নয়, মনসুখ।
পঞ্চমতঃ ইমামের পেছনে ক্বিরআত
লা-মাযহাবীদের আরেক নতুন কথা হলো ইমামের পেছনে মুক্তাদী ক্বিরআত পড়তে হবে। অন্ততঃ সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। কখনো বলে নিচু স্বরে, যখন ইমাম ক্বিরআত পড়েন, তখন মুক্তাদীকে ক্বিরআত পড়তে হবে।
অথচ হাদিস শরীফে ব্যাপকভাবে বলা হয়েছে, ইমামের পেছনে নামায পড়লে মুক্তাদী কিরআত পড়বে না-
হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের নামায শিখিয়েছেন, বলেছেন যখন তোমরা নামাযে যাবে তোমাদের একজন ইমামতি করবে এবং ইমাম যখন ক্বিরআত পড়বে তোমরা তখন চুপ থাকবে। [মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ. ১৭৪, আদদেরায়া ফি তখরীজে আহাদীসে হেদায়া, ১ম খন্ড, পৃ. ১৬৪, মুসনাদে আবী আওয়ানা, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩৩ আহমদ]
হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে ক্বিরআত ইমামই পড়বে আর মুক্তাদী নীরব থেকে শুধুই শুনবে। এ হাদীস একদিকে যেমন মুক্তাদী ক্বিরআত না পড়ার জন্য দলিল অপরদিকে এটা সূরা আ’রাফ এর ২০৪ নং আয়াতের তাফসীরও বটে। ‘‘আর যখন ক্বোরআন তিলাওয়াত করা হবে তখন কানপেতে শুন এবং চুপ থেকো যাতে তোমাদের উপর রহমত বর্ষিত হয়।’’ আ’রাফ ২০৯, পারা-৯ আয়াতকে পড়বে তা বলা হয়সি হাদিসে তা পরিস্কার করা হয়েছে পাঠক হলো ইমাম। অথএব বুঝা গেল মুক্তাদী ইমামের পেছনে ফাতিহাও পড়বে না কোন ক্বিরআতই পড়বে না। হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনাতেও তার কথা বলা হয়েছে-ইমাম এ জন্য বানানো হয়েছে যেন তাকে অনুসরণ করা হয়। অতএব ইমাম তাকবীর বললে তোমরাও তাকবীর বলো ইমাম ক্বিরআত পড়লে তোমরা চুপ থেকো। [নাসা‘ঈ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১২]
হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার ইমাম আছে ইমামের ক্বিরআত-ই তার জন্য ক্বিরআত। [মুয়াত্তা, ৮৯পৃ. মুসনাদে ইমাম আযম, পৃ. ৬১] এ হাদীসগুলো সহীহ্ এবং এর সকল রাভী বিশ্বস্থ ও নির্ভরযোগ্য আহলে হাদীসরা বোখারী-মুসলিমের একটি রেওয়ায়েত ‘‘লা-সালাতা ইল্লা-বি ফাতিহাতাল কিতাব’’ এ হাদীস দ্বারা যে মুক্তাদীকেও সূরা ফাতিহা পড়তে হবে বলে দলিল দিয়ে থাকেন সে হাদিসে তো ফাসা-‘ইদান শব্দও আছে, যার অর্থ সূরা ফাতিহা ও আরো কিছু আয়াত ছাড়া নামায হবে না। সে হাদীস অনুসারে তো মুক্তাদীরদেরকে ফাতিহা কেরাত সব পড়তে হবে, আহলে হাদীসরা তো বলে না শুধু ফাতিহা পড়তে বলে তাও আবার জোহর ও আসরে। যেখানে চুপে চুপে ক্বিরআত পড়া হয়। আহলে হকের কথা হলো- এ হাদিসের ব্যাখ্যা সুফিয়ান সাওরী করেছেন- যা আবূ দাঊদে উল্লেখ আছে لمن يصىل وحده অর্থাৎ যে একাকী নামায পড়বে তার জন্য এ হাদীস প্রযোজ। জামাতে পড়লে আগের হাদীস অর্থাৎ فقراءة الامام له قراة ইমামের ক্বিরআতই মুক্তাদীর ক্বিরআত প্রযোজ্য।
মোটকথা, আলহামদুলিল্লাহ্, আহলে সুন্নাতই সঠিক ও সরল পথে আছেন। মাযহাবের অনুসরণ আহলে সুন্নাতেরই আক্বীদা। বর্তমানে বিশ্বে হানাফীম, শাফে‘ঈ, মালেকী ও হাম্বলী- যে চার মাযহাব রয়েছে এগুলো সত্য। এগুলোর মধ্যে যে কোন একটার অনুসরণ ওয়াজিব বা অপরিহার্য। পক্ষান্তরে, মাযহাবকে অস্বীকার করাও একটি মহা গোমরাহী বা ভ্রান্তি। মাযহাব অস্বীকারকারীদের গুরুঠাকুর হচ্ছে ওহাবী নেতা ইবনে আবদুল ওহাব নজদী। প্রথমে তার অনুসারী ও প্রচার করা তাল মিলিয়ে চলার জন্য মাযহাবের দিকে নিজেদের সম্পৃক্ত করলেও আরবে এখন তারা নিজেদেরকে তথাকথিত ‘সালাফী’ বলে পরিচয় দেয় এবং এ উপমহাদেশের ওহাবীদের ‘মাযহাববিরোধী সম্প্রদায়টি নিজেদের ‘ওহাবী’ না বলে তথাকথিত আহলে হাদীস’ বলে পরিচয় দেয়। উভয়ের আক্বীদা ও আমল এক ও অভিন্ন। তাই নির্দ্ধিদায় বলা যায়- ‘আসল ওহাবী’ ও ‘আহলে হাদীস’ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এদের থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখা ও তাদের খন্ডন ও প্রতিহত করা মুসলিম সমাজের উপর অপরিহার্য কর্তব্য।