ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ইসলামে বাইয়াতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী >

ভূমিকা: বাইয়াত বা শপথ ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। মানব জীবনে সফলতার জন্য বাইয়াতের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাইয়াতবিহীন মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু। বাইয়াত মানুষের জীবনকে সুন্দর, জ্ঞানগত পরিপূর্ণতা, মানুষের কল্যাণকামী ও উন্নত আমলের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে সাহাবীগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বাইয়াত নিয়েছেন। ১) বাইয়াতে রিদওয়ান ২) আকাবার শপথ ৩) হুদায়বিয়ার শপথ ও ৪) মক্কা বিজয়।
রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইন্তিকালের পর সাহাবায়ে কেরাম হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এর নিকট বাইয়াত হয়েছেন। মুসলিম সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত হয়েছিল তাঁর নিকট বাইয়াত হওয়া ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপক ভাবে স্বীকৃত।

বাইয়াত অর্থ
বাইয়াত আরবী শব্দ بَيْعٌ শব্দ থেকে গঠিত। بَيْعٌ অর্থ বেচা-কেনা, লেন-দেন, ক্রয়-বিক্রয়, তবে মূল অর্থ বিক্রয় করা। বিখ্যাত আরবী ইংরেজী অভিধান “মু‘জামুল লুগাতুল আরাবীয়্যাহ” যার সংকলক গওখঞঙঘ ঈঙডঅঘ তাতে بَيْعٌ অর্থ লিখা হয়েছে To Sell, To Make a Contract, To Pay Homage, To acknowledge Severing or leader etc. এ অভিধানে আরবী بَيْعٌ শব্দের অর্থ লিখা হয়েছে: Agreement, Arrangement business deal Commercial transaction, Bargain sale Purchase Homage etc.

কুরআনের পরিভাষায় بَيْع শব্দের ব্যবহার
কয়েকটি সুরায় بَيْعٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বেচা- কেনা, ব্যবসা- বাণিজ্য ও রুজি- রোজগারের উদ্দেশ্যে। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاء الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ“এরা এমন লোক, যাদেরকে ব্যবসা- বাণিজ্য ও ক্রয়- বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে,যে দিন অন্তর ও দৃষ্টি সমুহ উল্টে যাবে। (সুরা- নুর- ৩৭)
আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ “হে মুমিনগণ, জুমাআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়,তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ছুটে চল এবং বেচা-কেনা বন্ধ কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝে থাক।” (সুরা- জুমাআ- ০৯)
তবে আরো কয়েকটি সুরায় بيْع শব্দটিকে নিজের সত্তা, জান- মালকে কোন মহান উদ্দেশ্যে আল্লাহ ও রাসুলের নিকট সমর্পন করার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার বা ওয়াদা করা। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, إِنَّ اللّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللّهِ فَاسْتَبْشِرُواْ بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ “আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে, তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহেঃ অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জলি ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবচিল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দতি হও সে লেন-দেনের উপর, যা তোমাদের করেছ তাঁর সাথ। আর এ হল মহান সাফল্য।”  (সুরা তওবা- ১১১)

আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন, إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَى بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْرًا “হে রাসুল, যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করল, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করল। আল্লাহর কুদরতের হাত তাদরে হাতের উপর রয়েছে। অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যই করে এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার র্পূণ করে আল্লাহ সত্ত্বরই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন।” (সুরা ফাতহ- ১০)

আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন, لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত যা তাদের অন্তরে বিদ্যমান। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন। (সুরা ফাতহ- ১৮)
আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَى أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ “হে নবী, ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন র্গভজাত সন্তান বলে মথ্যিা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা র্প্রাথনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।” (সুরা মুমতাহিনা- ১২)

এই কয়েকটি আয়াতে মুমিনের জান- মাল, ইচ্ছা- বাসনা অর্থাৎ তার পূর্ণ সত্তাকে আল্লাহর ইচ্ছার নিকট সমর্পণ করা। আর এটাই ইসলাম কবুলের মর্মকথা । ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, আর বাইয়াতের মাধ্যমে আত্মসমর্úণের বাহ্যিক রূপ প্রকাশ পায়।

হাদীস শরীফে বাইয়াত
মুসলিম শরীফের হাদীসে রয়েছে:
عَنْ أَبِي مُسْلِمٍ الْخَوْلَانِيِّ ، قَالَ : حَدَّثَنِي الْحَبِيبُ الْأَمِينُ ، أَمَّا هُوَ فَحَبِيبٌ إِلَيَّ ، وَأَمَّا هُوَ عِنْدِي فَأَمِينٌ عَوْفُ بْنُ مَالِكٍ الْأَشْجَعِيُّ ، قَالَ : كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تِسْعَةً أَوْ ثَمَانِيَةً أَوْ سَبْعَةً ، فَقَالَ : ” أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللَّهِ ؟ ” ، وَكُنَّا حَدِيثَ عَهْدٍ بِبَيْعَةٍ ، فَقُلْنَا : قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، ثُمَّ قَالَ : ” أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللَّهِ ؟ ” ، فَقُلْنَا : قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، ثُمَّ قَالَ : ” أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللَّهِ ؟ ” ، قَالَ : فَبَسَطْنَا أَيْدِيَنَا ، وَقُلْنَا : قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَعَلَامَ نُبَايِعُكَ ؟ قَالَ : ” عَلَى أَنْ تَعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ، وَالصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ وَتُطِيعُوا ، وَأَسَرَّ كَلِمَةً خَفِيَّةً ، وَلَا تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا ، فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولَئِكَ النَّفَرِ ، يَسْقُطُ سَوْطُ أَحَدِهِمْ ، فَمَا يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ ” . ( )
“আওফ ইবনে মালেক আশজাঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন, আমাদের সাত বা আট বা নয়জন লোকের উপস্থিতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত হচ্ছো না? অথচ আমরা ইতিপূর্বে বাইয়াত গ্রহণের সময় আমরা তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছি। আমরা বললাম আমরা তো আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, তোমরা কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছ না? আমরা আবার বললাম আমরা তো আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি। তিনি পুনরায় বললেন, তোমরা কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছ না? বর্ননা কারী বলেন এবার আমরা হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম আমরা তো ইতিপূর্বে আপনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছি এখন আবার আপনার কাছে কিসের বাইয়াত গ্রহণ করব।” রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো তার সাথে কাউকে শরীক করো না। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করো এবং আল্লাহর আনুগত্য করো। তিনি আরো একটি কথা বললেন চুপে চুপে তা হলো লোকের কাছে কোন কিছুর জন্যে হাত পাতবে না।” ( )
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমানিত হয় যে, ইসলামের হুকুম আহকাম পালনের ব্যাপারে দৃঢ় থাকতে এবং তাকওয়া অর্জন করে মুত্তাকী হতে বাইয়াত গ্রহণ করা উচিত।
বুখারী শরীফ কিতাবুল আম্বীয়ার মধ্যে হাদীস এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ فُرَاتٍ الْقَزَّازِ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا حَازِمٍ، قَالَ قَاعَدْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ خَمْسَ سِنِينَ، فَسَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ، وَإِنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِي، وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ‏.‏ قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ فَالأَوَّلِ، أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ، فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ‏”‏‏( )
“আমার পরে কোন নবী আসবে না বরং খলীফার আগমন ঘটবে? তাদের সংখ্যা হবে অনেক।” সাহাবায়ে কেরামগণ প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ তাহলে আমাদেরকে কি নির্দেশ দেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তাদের প্রথম জনের বায়আত পূর্ন করো তারপর পরবর্তী জনের বায়আত পূর্ণ করো এভাবে করে তাদের হক্ব পূর্ণ করে দাও, কেননা আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের নিকট রাখা আমানত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন।” ( ) এ হাদীসটি প্রমান করে সনদওয়ালা মুহাক্কেক পীর-মাশায়েখের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে আর তাদের কাছ থেকেই দ্বীন শিখতে হবে। নতুবা পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী।
عَنْ مُعَاوِيَةَ أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ عَلَيْهِ إِمَامٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً হযরত মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তার কোন ইমাম নেই, সে আসলে জাহেলিয়াতের মরণ মারা গেল।” ( )
মুসলিম শরীফ ‘কিতাবুল ইমারাত’ এ এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ ، قَالَ : جَاءَ ابْنُ عُمَرَ إِلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُطِيعٍ ، فَلَمَّا رَآهُ قَالَ : هَاتُوا وِسَادَةً لأَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ ، قَالَ : إِنِّي لَمْ أَجِئْكَ لأَجْلِسَ ، إِنَّمَا جِئْتُكَ لأُحَدِّثَكَ بِحَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، سَمِعْتُهُ يَقُولُ : ” مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لا حُجَّةَ لَهُ ” . قَالَ : ” وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيَّةً ( )
“যে ব্যক্তি আনুগত্যের হাত উঠিয়ে নিল সে ব্যাক্তি এমন অবস্থায় কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হবে যে, তার মুক্তির স্বপক্ষে কোনও যুক্তি-প্রমান থাকবেনা, আর যে ব্যাক্তি এমন অবস্থায় মারা যাবে যার ঘাড়ে বায়আত নেই। সে যেন জাহিলিয়্যাতের অর্থাৎ অজ্ঞতার যুগের মৃত্যুবরন করল।”( ) বায়আত গ্রহণ ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু নসীব হবে। অতএব প্রশ্ন হলো আমরা কি অজ্ঞতার যুগের মৃত্যু চাই? শুধু তাই নয় ফখরুদ্দীন রাযী লিখেন “যার পীর নেই তার দ্বীন নেই।”
উপরোক্ত আয়াতে কারীমা এবং হাদীস সমূহ প্রমাণ করে বাইয়াত গ্রহণ করা শরীয়ত সম্মত কাজ। স্বনামধন্য মুহাদ্দিস আবদূল হক্ব মুহাদ্দেসে দেহলভী রাহঃ তার “কওলুল জামিল” কিতাবের মধ্যে লিখেন বাইয়াত গ্রহণ করা সুন্নাত। তাসাউফ শিখতে হলে অবশ্যই কামেল মুহাক্কেক পীরের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতেই হবে। যত্র তত্র বাইয়াত গ্রহন করা নিষিদ্ধ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ، عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: كُنَّا نُبَايِعُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ ثُمَّ يَقُولُ: ্রفِيمَا اسْتَطَعْتَগ্ধ وَقَالَ عَلِيٌّ: فِيمَا اسْتَطَعْتُمْ( ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কে বলতে শুনেছেন যে, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতাম, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপর এবং তিনি আমাদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী উক্ত আমল করার অনুমতি দিয়েছেন। ( )
وَالطَّاعَةِ فِى مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ قَالَ إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللهِ فِيهِ بُرْهَانٌ উবাদাহ বিন সামেত রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের নিকট থেকে আমাদের খুশী ও কষ্টের বিষয়ে, স্বস্তি ও অস্বস্তির বিষয়ে এবং আমাদের অগ্রাধিকার নষ্ট হলেও আনুগত্য ও আদেশ পালনের উপর এবং ক্ষমতাসীন শাসকের বিদ্রোহ না করার উপর বায়আত (প্রতিশ্রুতি) গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, “তবে হ্যাঁ, যদি তোমরা প্রকাশ্য কুফরী হতে দেখ, যাতে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন দলীল বর্তমান থাকে (তাহলে বিদ্রোহ করতে পার)।”( )
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসে উল্লেখিত এই “ক্রয়-বিক্রয়” মানে হচ্ছে আমার আমিত্বকে আল্লাহর রাহে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা নায়েবে রাসূলের কাছে কোরবান করে দিলাম, বিলীন করে দিলাম, বিক্রি করে দিলাম। আমার আমিত্ব, আমার যতো অহংকার আছে, অহমিকা আছে, ‘আমি’ ‘আমি’ যতো ভাব আছে, সমস্ত কিছু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা নায়েবে রাসূলের কাছে আল্লাহর রাহে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করে দেয়া, কোরবান করে দেয়া, বিক্রি করে দেয়া, এবং পক্ষান্তরে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছ থেকে কোরআন সুন্নাহ-ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা খরিদ করে, সমস্ত উপাসনার মালিক আল্লাহ, এবাদতের মালিক আল্লাহ, কুল মখলুকাতের মালিক আল্লাহ, এই দৃঢ় ঈমানে ঈমানদার হয়ে যাওয়া, এটাকেই বলা হয় বাইয়াত বা “ক্রয়-বিক্রয়”।

বাইয়াতের প্রকারভেদ
উপরোক্ত আয়া-ত ও হাদীস পর্যালোচনা করলে অন্তত পাঁচ ধরনের বাইয়াতের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন
১. খিলাফাতের বাইয়াত। যা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্বের প্রতীক হিসেবে নেয়া হয়ে থাকে।
২. বাইয়াতে ইসলাম। তথা ইসলাম গ্রহণের জন্য বাইয়াত নেয়া।
৩. তাকওয়া পরহেযগারীতে অগ্রগামী হবার শপথের বাইয়াত। যাকে বাইয়াতে তাসাওউফও বলা হয়।
৪. বাইয়াতে জিহাদ ও হিজরত। জিহাদ বা কাফেরদের জুলুমী রাষ্ট্র ছেড়ে দেয়ার বাইয়াত।
৫. জিহাদের ময়দানে দৃঢ় থাকার বাইয়াত। যদি কখনো জিহাদের ময়দানে ভয়ে পালিয়ে যাবার শংকা দেখা দেয়, তখন আমীরে জিহাদের হাতে দৃঢ়তার বাইয়াত গ্রহণ করা।
‘আল কাওলুল জামীল’ এ শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী বলেন, فالحق ان البيعة على اقسام، منها بيعة الخلافة، ومنها بيعة الاسلام، ومنها بيعة التمسك بحبل التقوى، ومنها بيعة الهجرة والجهاد، ومنها بيعة التوثق فى الجهاد،( )
আরবি শব্দের মূল অর্থ বিক্রয় বটে, কিন্তু এর গৌণ (ংবপড়হফধৎু) অর্থ হলো চুক্তি,শপথ, অংগীকার। বেচা-কেনার ব্যাপারে ক্রেতার ও বিক্রেতার মধ্যে যেসব শর্ত (ঃবৎসং) ঠিক করা হয় তা মেনে নেয়ার চুক্তির ভিত্তিতেই লেন-দেন হয়ে থাকে। এভাবেই বাইয়াত শব্দটি চুক্তি,শপথ,অঙ্গীকার শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়। আরবি শব্দের ক্রিয়া-বাচক শব্দ হলো আরবি এর অর্থ শুধু বিক্রয় শব্দেই সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ হয় চুক্তি করা, সম্মান প্রদর্শন করা, নেতৃত্ব মেনে নেয়া, আনুগত্যের শপথ করা, বিক্রয়ের জন্য পেশ করা, চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং ব্যবসায় লেন-দেন করা ইত্যাদি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যে বাইয়াত ছিল তা হলো বাইয়াতে রাসূল। খিলাফাতের যুগে ছিল বাইয়াতে খিলাফাহ। খিলাফাতের পর যে বাইয়াতের প্রচলন শুরু হয় তা হলো বাইয়াতে তাকওয়াহ। তাকওয়া অর্জনের জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে এ ধরনের বাইয়াত করিয়েছেন।

পীর-মুরীদি কী
সাম্প্রতিককালে দেখা যায় একটি মহল পীর-মুরীদির ঘোর বিরোধীতা করে আসছে। বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে সর্বস্তরে। বাইয়াত, পীর কর্তৃক খিলাফাত, যিকির ইত্যাদি পন্থাকেও অস্বীকার করে। এমনকি পীর-মুরীদিকে কুফরী পন্থা বলতেও দ্বিধা করে না। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে সঠিক বিধান মেনে দ্বীনের সহীহ ত্বরীকার উপর চলা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে হক্কানী আলেম ও পীর বুজুর্গ হতে আলাদা করা। তাদের অপ-প্রচারে ইতোমধ্যে যুব-সমাজসহ সরল মুসলমানদের একটি অংশ আলেম-ওলামা ও হক্কানী পীর মাশায়েখ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যারা এখনো তাদের ভ্রান্ত প্রচারে বিশ্বাসী না হয়ে আকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন, তারাও ঐ মহলটির খোঁড়া যুক্তির ব্যাড়াজালে দোদুল্যমান অবস্থায় কাতরাচ্ছে।
পীর শব্দের অর্থ: পীর শব্দটি ফার্সি। শব্দগতভাবে এর অর্থ হল ‘জ্ঞানি’। মূলতঃ অর্থে যিনি আল্লাহ পাককে পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে বা আল্লাহ পাক এর সাথে রূহানী সংযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, উনাকেই পীর সাহেব বলা হয়। কুরআন শরীফ ও হাদিছ শরীফে যাদের আউলিয়া, মুর্শিদ ও শায়খ বলা হয়েছে, ফার্সিতে তাদের পীর সাহেব বলা হয়।
মুরীদ শব্দের অর্থ: মুরীদ হলো مريد – يريد – اراد আভিধানিক অর্থ ইচ্ছাপোষনকারী, সংকল্পকারী, আনুগত্য পোষন কারী। কুরআন ও হাদীস শরীফে মুরীদ হওয়ার বিষয়টি এসেছে بيعة “বায়আত” নামে।

পীরের প্রয়োজনীয়তা কি?
ইসলামে তাসাউফ তথা শরীয়তের পাশাপাশি তরীকত হাকীকত ও মারেফাত অর্জন এবং সে জন্য পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ একটি অত্যাবশকীয় বিষয় যা কোরআন হাদীছ ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা সাব্যস্ত।
এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক বলেনঃ لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাকের বড়ই ইহসান যে তাদের মধ্যে হতে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ পাকের আয়াতগুলো তেলায়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও হিকমত (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হেদায়েত প্রাপ্ত ছিল না। (সূরা আল এমরান, আয়াত-১৬৪)
আল্লাহপাক তাঁর কালাম পাকে এরশাদ করেনঃ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ “আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি জীবন বিধান বা শরীয়ত, অপরটি তরীকত-সম্পর্কিত বিশেষ পথ নির্ধারণ করে দিয়েছি।
(সূরা মাইয়িদা, আয়াত ৪৮)
আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে আরও এরশাদ করেন: وَأَن لَّوِ اسْتَقَامُوا عَلَى الطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُم مَّاءً غَدَقًا “ তারা যদি তরীকতে (সঠিক পথে) কায়েম থাকতো তাহলে আমি তাদেরকে সুমিষ্ট পানীয় দিতাম। (সূরা জ্বীন, আয়াত-১৬)
মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এরশাদ করেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আর সাদেকীনদের সঙ্গী হও”। (সূরা তওবা, আয়াত-১১৯)
এ আয়াত পাকে আল্লাহ পাক মূলতঃ পীর-মাশায়েখগণের সঙ্গী বা সোহবত এখতিয়ার করার কথা বলেছেন। কারণ হক্কানী মুর্শিদগণ-ই হাকীকি ছাদেকীন।
আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা কোরআন শরীফের প্রথম সূরাতেই শিখিয়ে দিচ্ছেন اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ“আমাদের সরল সঠিক পথে [সীরাতে মুস্তাকিমে] পরিচালিত করো। তাঁদের পথ যাঁদেরকে তুমি নিয়া’মত দান করেছো।” (সূরা ফাতিহা, ৬-৭)
সূরায়ে ফাতিহায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন, সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম। আর তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা হলেনঃ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ وَحَسُنَ أُولَٰئِكَ رَفِيقًا “যাদের ওপর আল্লাহ তা’আলা নিয়ামত দিয়েছেন, তাঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেককার বান্দাগণ।” (সূরা নিসা, ৬৯)
এ দু’আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ তথা আল্লাহ’র অলীগণ। যাঁদের শানে আল্লাহ্ নিজেই ঘোষণা দেন, أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ “সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহ’র অলী বা বন্ধুগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁদের কোনো চিন্তা-পেরেশানী নেই।” (সূরা ইউনূস, ৬২)
আর ওই সকল প্রিয় বান্দাদের পথ-ই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ, তাঁদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলা হয়ে যাবে।
আল্লাহ পাক তাঁর পাক কালামে আরো এরশাদ করেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহপাককে ভয় করো, আর তাঁর সন্তষ্টি লাভের জন্য উছিলা গ্রহণ করো। (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩৫)
মুফাসসিরীনগণ বলেন, উল্লেখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত উছিলা দ্বারা তরীকতের মাশায়েখগণকে বোঝানো হয়েছে। যেমন তাফসীরে রুহুল বয়ানে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, الوصل لا يحصل الا بالوسلية وهي العلماء المحققون ومشائخ الطرق الصوفية অর্থাৎ, উক্ত আয়াতে উছিলা ছাড়া উদ্দেশ্যকে (আল্লাহ্কে) লাভ করা যাবেনা, আর সে উছিলা হলো মুহাক্কীক আলেম বা যিনি তরীকতের শায়খ বা পীর।
কামেল পীর-মুর্শিদের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন مَن يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ ۖ وَمَن يُضْلِلْ فَلَن تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُّرْشِدًا“যে ব্যক্তি হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক তাকে হেদায়ত দেন, আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ থাকে সে কখনও অলিয়ে কামেল মুর্শিদ খুঁজে পাবে না”। (সূরা-কাহাফ, আয়াত-১৭)
উক্ত আয়াত শরীফের দ্বারা মূলতঃ এটাই বোঝানো হয়েছে যে ব্যক্তি কোনো কামেল-মোকাম্মেল পীর সাহেবের কাছে বাইয়া’ত হয়নি, সে ব্যক্তি গোমরাহ।
আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ۖ “সেই দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমামের (শায়খের) নামে আহ্বান করবো। (সূরা বনি ইসরাঈল-৭১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে “আ’রায়েসুল বয়ান”-এ উল্লেখ রয়েছে, ويدعو المريدين باسماء مشائخهم অর্থাৎ, হাশরের দিন প্রত্যেক মুরীদকে ডাকা হবে যার যার শায়খ বা পীরের নামে। তাই পীরের দলভুক্ত হয়ে আল্লাহ’র দরবারে হাজিরা দিতে হবে।
যাহেরী আমল তথা দেহের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত আমল ও তার মাসআলা-মাসাঈল শিক্ষা করার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, এটিই নিয়ম। উস্তাদ ছাড়া এসব কাজ সঠিকভাবে আদায় হয় না। কিন্তু বাতেনী আমলের ফরয, ওয়াজিব, হারাম, মাকরূহ- যেগুলো তাসাউফ ও ত্বরীকতের মধ্যে বর্ণনা করা হয়, সেগুলোর ইলম হাসিল করা এবং সে অনুপাতে আমল করার জন্য উস্তাদের প্রয়োজন তার চেয়েও অধিক। এ সমস্ত বিষয়ের উস্তাদকে পরিভাষায় শাইখ, মুরশীদ বা পীর বলা হয়। আধ্যাত্মিক ব্যাধি ও মন্দ চরিত্রসমূহ বোঝা এবং সেগুলোর চিকিৎসা ও সংশোধন করা সাধারণতঃ পীর বা মুরশীদ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই যে ব্যক্তি এ পথে পা রাখবে, তার জন্য মুরশীদের সন্ধান করা জরুরী। সন্ধান করে এ ধরণের পীর পেলে, তাঁর শরণাপন্ন হবে এবং পরিপূর্ণরূপে তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশনা মেনে চলবে। কেউ যখন পীরের শিক্ষা বা ছবকানুযায়ী আমল করতে আরম্ভ করবে, তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে যে, নিজের যাহেরী ও বাতেনী আমল সহীহ করতে জায়গায় জায়গায় পীর ও মুরশীদের প্রয়োজন পড়ে। একজন কামিল পীরের পথপ্রদর্শন ছাড়া তওবা ইত্যাদি পরিপূর্ণ হওয়া জটিল ব্যাপার।

জামে উল উছুল-এ সূরা মোহাম্মাদের তাফসিরে আছে- হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, যিনি তৎকালীন জগৎবিখ্যাত তাফসির বিশারদ ও তাফসিরে কবীরের লেখক। তিনি হযরত ইমাম ছাঞ্জালী বা নাজিমুদ্দীন কোবরা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে মুরিদ হওয়ার জন্য যান। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর ভিতরে এলেমের কিছুটা ফখর (অহঙ্কার) থাকার কারণে তিনি বলেছেন, আমার কাছে মুরিদ হলে তোমার ইলেম ভুলে যেতে হবে। এই কারণে তিনি তার কাছে মুরিদ হলেননা। মৃত্যুর সময় ইবলিস নানা প্রকার প্রশ্ন করবে এই চিন্তা করে ‘আল্লাহ এক’ সম্পর্কে ৩৬০ খানা দলিল মুখস্ত করে রেখেছিলেন। তাঁর ইন্তিকালের সময় ইবলিস এসে আল্লাহ তায়া’লার একত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন ও তর্ক-বির্তক আরম্ভ করল, তিনি ৩৬০ খানা দলিল দ্বারা আল্লাহ তায়া’লার একত্ব সম্পর্কে প্রমাণ করলেন। ইবলিস যুক্তি-তর্ক দিয়ে তাঁর সব দলিল বাতিল করে পরে জিজ্ঞাসা করল, হে ফখরুদ্দীন রাযী! তুমি আল্লাহ তায়া’লার একত্ব সম্পর্কে আর কত দলিল দিতে পারবে? তখন হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী হতবুদ্ধি হয়ে বলেছিলেন, আমি আর দলিল জানি না। যখন তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন তখন হযরত ছাঞ্জালী বা নাজিমুদ্দীন কোবরা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রুহানিভাবে জানতে পেরে তাঁর প্রতি দয়া করেছিলেন। তিনি ইমাম রাযীর প্রতি কিছু ওযুর পানি ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, হে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী! তুমি বল আমার আল্লাহ বিনা দলিলে এক। তখন ইবলিস বলেছিল, হে ফখরুদ্দীন রাযী তোমার পিছনে যদি কামেল পীর না থাকত তবে আমি দেখতাম, তুমি কেমন করে ইমান নিয়ে কবরে যেতে। ( )

তথ্যসূত্র.
– صحيح مسلم গ্ধ كِتَاب الزَّكَاةِ গ্ধ بَاب كَرَاهَةِ الْمَسْأَلَةِ لِلنَّاسِ رقم الحديث: ১৭৩৬(
– (মুসলিম, হা-১৭৩৬)
– ( صحيح البخاري গ্ধ كتاب أحاديث الأنبياء গ্ধ باب ما ذكر عن بني إسرائيل. ৩২৬৮ صحيح البخاري – (৪৬২৭) صحيح مسلم – الإمارة (১৮৪২) مسند أحمد – باقي مسند المكثرين (২/২৯৭)
– (বুখারী-৩২৬৮, ৪৬২৭, মুসলিম-১৮৪২, আহমদ২/২৯৭)
– (ঐ ১০৫৭ নং,)
– أخرجه مسلم في صحيحه (১৮৫১) صحيح مسلم – الإمارة (১৮৫১) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৭০) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৮৩) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৯৩) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৯৭) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/১১১) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/১২৩) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/১৩৩) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/১৫৪)
– (মুসলিম-১৮৫১, আহমদ ২/৯৭, ২/১১১, ২/১৩২)
– ) صحيح البخاري – الأحكام (৬৭৭৬) صحيح مسلم – الإمارة (১৮৬৭) سنن الترمذي – السير (১৫৯৩) سنن النسائي – البيعة (৪১৮৭) سنن أبي داود – الخراج والإمارة والفيء (২৯৪০) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৯) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৬২) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/৮১) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/১০১) مسند أحمد – مسند المكثرين من الصحابة (২/১৩৯)
– (বুখারী-৬৭৭৬, মুসলিম-১৮৬৭, তিরযিী-১৫৯৩, নাসায়ী-৪১৮৭, আবু দাউদ-২৯৪০, আহমদ-২/৯,২/৬২. ২/৮১.২/১০১.২/১৩৯)
– (বুখারী ৭০৫৬, মুসলিম ৪৮৭৭ নং)
– (القول الجميل مع شرح شفاء العليل(
– ( জামে উল উছুল সূরা মোহাম্মাদের তাফসির দ্রষ্টব্য)

Share:

2 Comments

  1. শাহীদ আল ইসলাম

    Says Shawwal 09, 1444 at 8:15 pm

    আস্সালামু আলাইকুম।
    ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি র. এর মৃত্যুর সময়ে ইবলিশের সাথে সংঘটিত ঘটনা কিভাবে জানা গেল?

    • Monthly Tarjuman

      Says Shawwal 13, 1444 at 10:44 am

      জামে উল উছুল সূরা মোহাম্মাদের তাফসির দ্রষ্টব্য

Leave Your Comment