জশনে জুলুসে ঈদ-ই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সমাজ জীবনে- এর প্রভাব : কাজী মুহাম্মদ আব্দুল ওহাব

জশনে জুলুসে ঈদ-ই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সমাজ জীবনে- এর প্রভাব

কাজী মুহাম্মদ আব্দুল ওহাব

=============
পবিত্র মাহে রবিউল-আউয়াল। বিশ্ব মানবতার শান্তির দূত, মুক্তির দিশারী প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধরাধামে আগমনের মাস।

আরবী বর্ষপঞ্জীর তৃতীয় মাসের বর্তমান নাম ‘রবিউল আউয়াল’। এ মাসের নামকরণের সাথে সৃষ্টি জগতে আলোকবর্তিকা প্রদর্শনকারী, করুণারধারা রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর ধরাপৃষ্টে আবির্ভাবের এক অপূর্ব সামঞ্জস্যের কাহিনী প্রাচীন আরব ইতিহাসের ঐতিহাসিক বিবরণীতে পাওয়া যায়। প্রাচীন আরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক ঔযড়হ ঈষধৎশ অৎপযবৎ এর গবেষণা কর্ম “গুংঃরপধষ ঊষবসবহঃং রহ গড়যধসসধফ গ্রন্থের বর্ণনায় বলা হয়েছে “প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু, চরম দাবদাহ কবলিত রুক্ষ, ধূসর আরবের বর্ষপঞ্জীর এ মাসকে জাহেলিয়াত যুগে বলা হত “শাহরুল বালা” বা “দুঃখ দুর্দশার” মাস। আরবের রুদ্র প্রকৃতি তখন তপ্ত দাবদাহ ও প্রচন্ড সাইমুম ঝড় নিয়ে আবির্ভূত হত। এ সময় পার্শ্ববর্তী মেসোপটোমিয়া (ইরাক) এবং ইয়ামেন হতে যাযাবর মরু দস্যুরা মক্কা তায়েফ অঞ্চলে হানা দিয়ে এতদঅঞ্চলের পালিত পশু এবং খাদ্য সম্ভার লুঠ করে নিত। ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার’ মত এ সময় মক্কা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পানীয় জলের উৎসসমূহ (ঞধহশ) দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যেত। পানীয় জলের অধিকার নিয়ে গোত্রসমূহের মধ্যে কলহ বিবাদ ও গোত্রযুদ্ধ ছিল নিত্ত নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রাচীন আরবের সমর ইতিহাস গ্রন্থ ‘কিতাব-উল-মগাজী’তে এ গোত্র যুদ্ধের (ইধঃঃষব ড়ভ ডধঃবৎ) বিবরণ পাওয়া যায়। সমসাময়িক কালেই মক্কার কুরাঈশ গোত্রপতি আবদুল মুতালিব (হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের পিতামহ) কর্তৃক কাবা গৃহ প্রাঙ্গণে পবিত্র জমজম’- পুনরুদ্ধার এবং পরবর্তীতে ইয়ামেন স¤্রাট আবরাহা কর্তৃক মক্কার কাবাগৃহ” আক্রমণ ও তার অলৌকিক বিনাশের ঘটনা সংঘটিত হয়।

বিশ্বের অফুরন্ত করুণার আধার রাহমাতুল্লিল আলামিন হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর ধরাপৃষ্ঠে আগমনের বৎসরের (৫৬৯-৫৭০) প্রারম্ভ হতেই আরবের বৈরী প্রাকৃতিক আবহাওয়া ধীরে ধীরে তার আচরণ পরিবর্তন শুরু করে। জন ক্লার্ক আর্চারের মতে খ্রিস্টীয় ৫৭০ সালের আরম্ভ হতে মক্কা অঞ্চলের আবহাওয়ার এহেন পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠে। বাতাসের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। মক্কা ভূমি ক্রমে ক্রমে সঞ্জীবিত হয়ে উঠা শুরু করে। খর্জুর বিথীতে মুকুলের সমারোহ দেখা দেয়। আরবের সর্বত্র উৎফুল্লতা ও খুশীর আমেজ দেখা দেয়। আরবের কুরাইশরা এই সময়ের (মাসের) নাম দিয়েছিল খুশী ও আনন্দের মাস। পরবর্তী বছর হতে (৫৭০) এ মাসের নামকরণ হয় রবিউল আউয়াল বা প্রথম বসন্ত, সবুজ সঞ্জীবনী সমারোহের মাস। আল্লাহ সোবনাহু তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে সূরা আম্বিয়া’ ১০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ ফরমান’, ‘‘হে রাসুল (সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে সৃষ্ট জগতসমূহের জন্য রহমত হিসেবে’’ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে বিশ্বমানবতা ও সভ্যতার আলোকবর্তিকা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর আবির্ভাবের ফলে জগতের সমস্ত পঙ্কিলতা, কু-সংস্কার, অন্যায়, অবিচার, নৈরাজ্য, অবক্ষয় ও ধীরে ধীরে অপসৃত হতে শুরু করে।

ইসলামী মাস এবং দিবসসমূহের মধ্যে বারই রবিউল আউয়াল বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের কাছে পরিপূর্ণ ঈমানী চেতনা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত একটি অবিস্মরণীয় দিন। মহান আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টি জগতে যত প্রকারের নেয়ামত তাঁর বান্দাদের জন্য প্রদান করেছেন তৎমধ্যে তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ মোস্তফা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র এই ধরাধামে আগমনই হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত এবং এ নেয়ামত যেহেতু রবিউল আউয়াল মাসে এ ধরার বুকে আবির্ভূত হয়েছেন সেহেতু এই মাস বিশ্বে মুসলমানদের জন্য অতীব মহিমামন্ডিত খুশী ও আনন্দের মাস। আর খুশী ও আনন্দ প্রকাশিত হয় এই মাসে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পালনের মাধ্যমে। বছর ঘুরে এই মাসের শুভাগমনের সাথে সাথে প্রতিটি ঈমানদার নবীপ্রেমিক মুসলমানের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়।

ঈদ-ই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আল্লায়হি ওয়াসাল্লাম হচ্ছে সকল ঈদের সেরা ঈদ। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এ ঈদ না হলে ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল আযহা কোনটাই হতো না। রমজান মাসে সিয়াম সাধনা শেষে আমরা ঈদ উল্্ ফিতর এবং জিলহজ্ব মাসে ঈদ-উল আযহা পালন করে থাকি। এই দু’টি ঈদও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের উপহার দিয়েছেন বলেই আমরা তা পেয়েছি এবং তা পালন করে থাকি। পক্ষান্তরে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে ঈদ-ই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ ও ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন।

মহান আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে সূরা আম্বিয়া ৫৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ ফরমান [হে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম] ‘আপনি বলুন, আল্লাহ্্র অনুগ্রহ ও দয়া এবং সেটার উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের ধন-দৌলতের চেয়েও শ্রেয়”- এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া প্রাপ্তিতে খুশী প্রকাশ করা হয়। আল্লাহ্্র অগণিত অনুগ্রহ ও দয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দয়া ও অনুগ্রহ হচ্ছে রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এই জগতে প্রেরণ। এটা নিঃসন্দেহে জগতবাসীর জন্য খুশি ও আনন্দের বিষয়। অপরদিকে আল্লাহ্্ সোবহানাহু ওয়া তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে সূরা ইব্রাহীমের ৫নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন “তাদেরকে আল্লাহ্র দিনসমূহ সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিন” এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ্্ তা’য়ালা হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামের প্রতি এ আহ্বান জানান যেন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ’র দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। আর এই দিনগুলো হচ্ছে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা কর্তৃক তার সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত ও নেয়ামত প্রদানের দিনসমূহ। আল্লাহ্্র দিনগুলোর ব্যাখ্যা কুরআন পাকেই দেয়া হয়েছে। যেখানে হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে উব্ধৃত করে বলা হয়েছে “আর যখন মুসা (আলাইহিস সালাম) আপন সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, “স্মরণ করো তোমাদের উপর আল্লাহ্্র অনুগ্রহকে যখন তিনি তোমাদের ফেরআউন সম্প্রদায়ের কবল হতে মুক্তি দিয়েছেন [সূরা ইব্রাহীম- আয়াত-৬]

উল্লিখিত আয়াতের মর্মার্থ অনুসারে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায় যেদিন ফিরআউন হতে মুক্তিলাভ করেন সেদিন ‘আল্লাহর দিন’। অতএব খাতেমুন নবী হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণের দিনও ‘আল্লাহর দিন’। কারণ আল্লাহ্ই বলেছেন (হে রাসূল) আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি। অন্যদিকে ১১তম পারা সূরা তাওবায় ইরশাদ হচ্ছে, “অবশ্য তোমাদের নিজেদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট একজন রাসুল তাশরীফ এনেছেন। তিনি তোমাদের কল্যাণ কামনা করে থাকেন। তোমাদের দুঃখ কষ্ট তাঁর নিকট অসহনীয় বোধ হয়। তোমাদের মুমিনদের উপর তিনি ¯েœহশীল ও দয়ালু”। ‘সূরা আ’রাফ’-এর ৭৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে “অতএব আল্লাহ্’র অনুগ্রহ সমূহকে স্মরণ করো এবং দুনিয়ায় ফ্যাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না”।

উপরোল্লিখিত আয়াতে করিমায় আল্লাহ্্ তায়ালা তাঁর রহমত ও নিয়ামতসমূহকে স্মরণ করার সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এবং এই রহমত ও নিয়ামত প্রদানের দিন নিঃসন্দেহে ‘আল্লাহ’র দিন’ হিসেবেই বিবেচিত। যেহেতু সমগ্র সৃষ্টি জগতে হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লামই সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত ও নিয়ামত। এই রহমত ও নিয়ামত স্মরণ করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে অতীব শান-শওকত পূর্ণ জৌলুসের সাথে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্্যাপন করা।

আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে সুরা দোহার ১১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, “এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামতের ব্যাপক চর্চা এবং আলোচনা করুন।” অতি মর্যাদাবান সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্্ ইবনে আব্বাস তৎকৃত তফসীরে ইবনে আব্বাসে আয়াতে উল্লিখিত নেয়ামত শব্দ দ্বারা হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি আসাল্লামের নবুয়ত ও দ্বীন ইসলামকে বুঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্্র এই আদেশের যথার্থ বাস্তবায়ন হয় ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্্যাপনের মাধ্যমে।

যেহেতু খাতামুন নবীয়্যীন মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ধরার বুকে আবির্ভাবই আল্লাহ সোবহ্্ানাহু তা’য়ালার পক্ষ হতে সৃষ্ট জগতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত এবং এই শ্রেষ্ঠতম নেয়ামতের ব্যাপক চর্চার জন্যই জমানার দূরদর্শী মোজাদ্দিদ, গাউসে জামান, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও ত্বরীকত হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৯৭৪ সনে এক মোবারক পত্রের মাধ্যমে ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফে ‘জশনে জুল্্স’ এর মাধ্যমে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি এ জশনে জুলস এর রূপরেখা সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ’৭৪ সনের ১২ রবিউল আউয়াল চট্টগ্রামের বলুয়ার দিঘীর পাড়স্থ খানকা শরীফ হতে আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামেই প্রথম জশনে জুলুসে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) উদ্্যাপিত হয়। বিগত তিনটি যুগ ধরে এই জশনে জুলুসের পরিধি ব্যাপক হারে বর্ধিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়া, কাচালং হতে জৈয়ন্তিয়া সর্বত্রই নগরে শহরে বন্দরে এমনকি গ্রাম পল্লীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাহে রবিউল আউয়াল আগমনের সাথে সাথে জশনে জুলুস এর মাধ্যমে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মোবারক বেলাদত শরীফের নিষ্কলুষ আনন্দ ও খুশীর বহিঃ প্রকাশ ঘটানো হয়।

প্রথম দিকে কিছুটা অজ্ঞতাজনিত বিভ্রান্তির কারণে বিভিন্ন সিলসিলার কতিপয় মাশায়েখদের মধ্যে সামান্য দোদ্যুল্যমনতা থাকলেও যুগ বিবর্তনে বর্তমানে সকল সিলিসিলার ত্বরিকতপন্থীরা তা কাটিয়ে উঠে নব উদ্যমে জশনে জুলুসে অংশগ্রহণ করছেন এবং নিজেরাও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জশনে জুলুসের মাধ্যমে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) পালন করছেন। এমন কি প্রথম দিকে নবীদ্রোহী বাতিল ফেরকা ওহাবী, মওদুদী, জমাতী ও লা মজহাবীরা এ গেল গেল ধর্ম গেল, বিদাত এলো….. ইত্যাদি শোরগোল তুলে জশনে জুলুসের প্রচন্ড বিরোধিতা করলেও যুগ পরিক্রমায় তা গরল পানের মতো নিজেরাও ভিন্নভাবে ‘বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে লোক দেখানো মিছিলের আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছেন।

বস্তুত পক্ষে জশনে জুলুসে ঈদ-ঈ-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্্যাপন মুসলিম সমাজ এর উপর কালজয়ী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। এবং সুন্নী জনতাকে পারস্পরিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলহ-বিবাদকে দূরীভূত করে সুন্নী জনতার বৃহত্তর ঐক্য সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

জশনে জুলুছে ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উদ্্যাপন বর্তমান সমাজে একটি সুন্দর ও সুরুচিপূর্ণ ইসলামী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। জশনে জুলুসের দিন প্রভাত হতেই ইথারে ভেসে আসে পুলক ও শিহরণ জাগানো সুললিত কণ্ঠের হামদ ও নাত। বর্তমানের পাশ্চাত্য বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন যেখানে মুসলিম কিশোর ও তরুণ সমাজকে প্রতিনিয়ত কুরুচি ও অশ্লীলতার দিকে হাতছানি দিচ্ছে সেখানে জশনে জুলস এক কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মুসলমান কিশোর ও তরুণ সমাজকে ইসলামী সংস্কৃতির পূত-পবিত্রতা সম্পর্কে আগ্রহান্বিত করে তুলছে। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত ইসলাম এবং ইসলামের তাহজীব – তমদ্দুন সম্পর্কে জানার কৌতূহল সৃষ্টি করছে। বর্তমানে জশনে জুলুসে এই ধরনের কিশোর ও তরুণের অংশগ্রহণের ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়।

জশনে জুলুসে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইয়হি ওয়াসাল্লাম মুসলমান যুব মানসে ইতিমধ্যেই নীরব বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি, প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী, কুরআন ও হাদিসের প্রকৃত ব্যাখ্যা সম্পর্কে তরুণ যুব সমাজ ব্যাপকভাবে পড়াশুনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে কুরআন হাদিস সম্পর্কে বাতিল পন্থীদের মনগড়া ব্যাখ্যা হালে পানি পাচ্ছে না। “জশনে জুলুস” সমাজে সুন্নাহ’র চর্র্চাকে মুসলমানদের অন্তরে গ্রথিত করে লুপ্ত প্রায় সুন্নাহর চর্চা পুনরুজ্জীবিত করেছে।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বে শান্তি ও প্রগতির ধর্ম ইসলাম একটি নব চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষত আধুনিক বিশ্বের যান্ত্রিক সভ্যতা ও উচ্ছৃঙ্খল ভোগবাদিতা হতে নতুন প্রজন্মের কিশোর তরুণেরা মুখ ফিরিয়ে ইসলামের সার্বজনীন মানবতাবোধের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে সা¤্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি আতংকিত হয়ে ইসলামের এ নবজাগরণকে রুদ্ধ করার হীন কৌশল গ্রহণ করে। এদেরই প্রচ্ছন্ন মদদে মুসলমানদের মধ্যেই সৃষ্টি হয় একদল বিভীষণ। পূর্ব থেকেই এরা ইসলামের মূল মর্মবাণী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাপবিত্র কুরআনের বাণী এবং হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ‘হাদিস’সমূহের অপব্যাখ্যা দিয়ে মুসলিম সমাজে ফেৎনা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি বাতিল ফেরকার জন্ম দিয়েছিলো। এবার প্রাশ্চাত্যের সূক্ষ্ম মদদে ইসলামের মহান শিক্ষা ‘জিহাদ’-এর ভ্রমাত্মক ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণ সমাজকে ইসলামের নামে, জিহাদের নামে সশস্ত্র জঙ্গিপনার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লোভনীয় প্রলোভনে প্ররোচিত করে বিপথগামী করে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে। বস্তুতঃপক্ষে জিহাদের ভ্রান্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে নবী অলি বিদ্বেষী ইসলাম বিরোধীরা সুপরিকল্পিতভাবে জিহাদের নামে সন্ত্রাস, জঙ্গিপনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। জশনে জুলুসে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এ ধরনের ইসলামবিরোধী, শান্তি বিনষ্টকারী অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে এক দূর্লংঘ্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। জশনে জুলুসের মাধ্যমে সামাজিক শান্তি এবং সৌভ্রাতৃত্বের বাণীই সকল মহলে সার্থকভাবে পৌঁছে দেয়া হয়। এই মর্মবাণীর কারণেই জশনে জুলুসে অংশগ্রহণকারী কোন সুন্নী কিশোর তরুণই এখনো পর্যন্ত কোনরূপ সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিপনার সংস্পর্শে আসেনি। আলহামদুলিল্লাহ- কোন সুন্নী কিশোর তরুণের বিরুদ্ধে কখনও জঙ্গিপনা বা সন্ত্রাসের অভিযোগ কেউ তুলতে সক্ষম হয়নি।

মূলত ঐতিহাসিক এই জশনে জুলুসে ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) উদ্্যাপনের মাধ্যমে মুসলমানদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজজীবনে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব এক সৌভ্রাতৃত্ববোধ, শান্তি অন্বেষা এবং নিরুদ্বেগ জীবন যাপনের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধি-বিধান চর্চায় সুখী সমৃদ্ধ ব্যক্তি জীবন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক