সুন্নাতে রাসূল’র জীবন্ত রূপ আমাদের মুর্শিদ

সুন্নাতে রাসূল’র জীবন্ত রূপ আমাদের মুর্শিদ

সুন্নাতে রাসূল’র জীবন্ত রূপ আমাদের মুর্শিদ-
মোহাম্মদ আনিসুজ্জমান >

গাউসে যামান, কুত্ববুল ইরশাদ, মুর্শিদে বরহক, আ-লে রাসূল, সুন্নী মুসলমানদের বিশ্বখ্যাত বৃহত্তম ‘জশনে জুলুস’র মহান প্রবর্তক, রূপকার বিশ্বনন্দিত সেবাধর্মী অনন্য আধ্যাত্মিক সংগঠন গাউসিয়া কমিটির মহান প্রতিষ্ঠাতা হুযূর ক্বিবলাহ্ আল্লামা হাফেয ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যবক্স শাহ্ আলাইহির রাহমাহ এক অবিস্মরণীয়, যুগস্রষ্টা, আধ্যাত্মনিলীমার অত্যুজ্বল জ্যোতিষ্ক। যাঁর আলোক-প্রবাহে স্নাত বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠি। নবী প্রেমের অমীয় সুধা পরিবেশন করে যিনি পরিতৃপ্ত করেছেন অসংখ্য মুমিনের তৃষিত হৃদয়। যাঁর সম্পর্কে গুণপনার কোন দিক সম্পূর্ণ আলোকপাত করার প্রচেষ্টা অন্তত আমার মত নগন্য গুণগ্রাহীর জন্য শিশুর হাতে প্রশান্ত মহাসাগর আন্দোলিত করার প্রচেষ্টার চেয়েও হাস্যকর। কাকে মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা দেখানো, যাঁকে নিয়ে কৌতূহলী লেখনীর প্রয়াস চালাতে উদ্যোগী যুগশ্রেষ্ঠ, বরেণ্য, অনুসন্ধিৎসু, প্রথিতযশা লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদ, মননশীল শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, ফক্বীহ্সহ অজস্র কলম যোদ্ধা ও বোদ্ধামহল শৈশবে আওড়ানো অনেক আপ্তবাক্য হতে একটি এই মুহূর্তে স্মৃতিতে অনুরণন জাগাচ্ছে, যা ফরমাশে কলম ধরার হেতু বর্ণনায় বলতে পারি, ‘মহাজ্ঞানী, মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়/সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তিÑধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয়।’’ ভাবতেই গর্বে বুক দুলে ওঠে, অবিশ্বাস্য মনে হয় নিজের সৌভাগ্যকে আমি তাঁর দীক্ষা গ্রহণ করেছি! কাছে থেকে তাঁর নুরানী অবয়ব স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছি! তাঁর একাধিক অনুগ্রহ লাভে কৃতার্থ আমি! বহুবিধ মর্যাদায় তিনি অনন্য ইমেজে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন।

মুর্শিদে বরহক হুযূর ক্বিবলাহ্ সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শুধু উচ্চ বেলায়তের অধিকারী ছিলেন, তা নয়। বেলায়তের সাথে সাথে মহান নেয়ামত নবী বংশজাত সাদা-তে কেরামের অন্যতম হওয়ার বিরল সৌভাগ্যেরও অধিকারী। যা সাধনা-প্রচেষ্টায় কেউ অর্জন করতে পারে না। এটি মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান সে অনুগ্রহে ধন্য করেন। কঠিন হাশরের দিন শুধুমাত্র নবী বংশ ছাড়া আর সব বংশ পরিচয় কর্তিত হয়ে যাবে। যে বংশধারা সেদিনও সগৌরবে স্বীয় মর্যাদায় আত্মপরিচয় অটুট রাখবে আ’লে রাসূল মুর্শিদে বরহক সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সেই শ্রেষ্ঠতম পবিত্র বংশ ধারায় আবির্ভূত হয়েছেন। নবীকুঞ্জের মন মাতানো ফুল, আওলাদে রাসূল, গাউসে যামান সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৩৩৬ হিজরী মোতাবেক ১৯১৬ খৃস্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জিলার অন্তর্গত সিরিকোট শেতালু শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। বংশ পরম্পরায় তিনি সায়্যিদুস্ সা-দা-ত, সরওয়ারে কায়েনাত, নবীয়ে আকরাম, রাসূলে মুআয্যম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র উনচল্লিশতম আওলাদ। রোজ হাশরের কঠিন সময়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ’র বংশ গৌরব উচ্চকিত থাকবে।

তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতাকে চিনে না, এমন সুন্নী মুসলমান পাক-ভারত বাংলাদেশে কম পাওয়া যাবে। এ দেশের বৃহত্তম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, ইশকে রাসূলের পয়গাম নিয়ে আসা মহান আধ্যাত্মিক সাধক, শাহিনশাহে সিরিকোট, শাহ্সূফী আল্লামা হাফেজ ক্বারী হযরত সায়্যিদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির আধ্যাত্মিক অবদানে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠি থাকবে চিরঋণী। জামেয়ার অপরূপ ‘জান্নাত নিশাঁ’র মনোরম শোভা প্রাণ জুড়াবে, নয়ন জুড়াবে যে কোন সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষের। এ জামেয়া বাতিলপন্থীদের বাতুলতার সয়লাব থেকে রক্ষা পেতে মুক্তির আশ্রয়কেন্দ্র, যেমন মহাপ্লাবন থেকে বাঁচার জন্য নূহ্ আলায়হিস্ সালামের কশতী। তাঁরই উত্তরসুরী যোগ্য সন্তান সায়্যিদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় জামেয়ার সুনাম, স্বীকৃতি আজ বিশ্বজোড়া।

হুযূর ক্বিবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহির শুভ জন্মের পূর্ব থেকেই তাঁর অসাধারণত্য, অলৌকিকত্ব প্রভৃতি আভাস দিয়েছিল যে, কালজয়ী এক মহান সংস্কারক’র আবির্ভাব ঘটবে, যাঁর শুভ আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় প্রহর গোণে শতাব্দী, মহাকালও। যেমন, তাঁর শ্রদ্ধেয় আব্বাজান বা-নিয়ে জামেয়া, কুতবুল আউলিয়া হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে স্বীয় পীর-মুর্শিদ, মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল শরীফ’র মহান প্রণেতা, ইলমে লদুনীর ধারক-বাহক খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শাহাদত আঙ্গুলি টেনে নিয়ে নিজ মেরুদন্ডের উপরে ঘষে ঘষে বলেছিলেন, ‘‘ইয়ে পাক চীজ তুম লে লো।’’ এ ঘটনায় শ্রদ্ধেয় পিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁরই পবিত্র ঔরশে অচিরেই আবির্ভূত হবেন জ্যোতির্ম্ময় কোন মহাপুরুষ। তিনি আর কেউ নন, লাখো বান্দার রূহানী রাহবার, আ-লে রাসূলে ইবনে হায়দার আমাদের প্রাণপ্রিয় হুযূর কিবলাহ্ সায়্যিদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি, সেই ‘পাক চীজ’ বা পবিত্রতার মূর্তরূপ হয়ে।

শরীয়ত-তরীকতের বাস্তব রূপায়ণকারী, দেহ-মনের শুচিতা প্রদর্শনকারী হুযূর সায়্যিদ তৈয়ব শাহ্’র নামকরণের মধ্যেও পূঞ্জিভূত হয়ে আছে জানা-অজানা অনেক রহস্যের প্রচ্চন্ন ইঙ্গিত। খাজা চৌহরভী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কারামত, শাহিনশাহে সিরিকোট রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সৌভাগ্য, যোগ্যতার অগ্রিম স্বীকৃতি, অপার রহস্যের ভবিষ্যতের আগাম ইঙ্গিত, আল্লামা সায়্যিদ তৈয়ব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহির অভাবনীয় কামা-লিয়ত’র প্রভূত সম্ভাবনাকে যথাযথ মর্যাদায় বরণ করার ইঙ্গিতময় নির্দেশনা। সাধারণ মানুষ আমরা অধিকাংশরাই ভাবি, নাম দিয়ে আর কাম কী? ডাকার জন্য রাম, শ্যাম, যদু, মধু-একটা রাখলেই হয়; কিন্তু সোনালী ভবিষ্যতের সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির মহাপুরুষদের কোন কাজই খেলনা-ফেলনাধর্মী নয়। হাদীস শরীফে রয়েছে, আশরাফুল মাখলুকাত ইনসানের নামগুলো আসমান হতে স্থির পূর্বক যমীনে আসে। মূর্তিমান পবিত্রতা হয়েই পৃথিবীতে এসেছেন হযরত তৈয়্যব শাহ্। তৈয়ব শব্দের অর্থই হল পবিত্র। কর্মজীবনে নামের বাস্তবায়নের প্রত্যাশায় মা-বাবা একটি ভালো অর্থবহ, রুচিসম্মত, সুন্দর নাম রাখতে চেষ্টা করেন। সৌভাগ্যবান মা-বাবা, অভিভাবকদের, সন্তান, পোষ্যরা সে প্রত্যাশা পূরণ করেন। হুযূর ক্বিবলার জন্য এ নাম ‘ইস্ম বা মুসাম্মা (অর্থাৎ ব্যক্তি অনুযায়ী নাম) হয়েছে। কর্মজীবনের শেষে প্রমাণিত হয়েছে তিনি শুধু নাম’র দাবীই প্রতিষ্ঠিত করেননি; বরং এ নাম তাঁকেই সাজে। এর বিপরীতে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কানা ছেলের নাম হয় পদ্মলোচন। তখন নাম’র সুন্দর অর্থটাই ব্যক্তির কারণে মাঠে মারা যায়। তখন শব্দটাই তাকে ধিক্কার দেয়। প্রবাদ সৃষ্টি হয়, ‘‘বানরের গলায় মুক্তোর মালা।’’ এ মহান ব্যক্তিত্ব বরং নামটার শ্রীবৃদ্ধি, গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। তাঁর কারণে নাম’র অর্থ উজ্জ্বলতর হয়েছে। হয়েছে আরো গৌরবান্বিত।

ভাবতে পুলকিত হই, আমরা যে কলেমা শরীফ স্বীকার করে মুমিন মুসলিম বলে পরিচিত হই, আল্লাহর রাসূল প্রথম স্বীকৃতির আহ্বান তাঁর উম্মতের কাছে উত্থাপন করেন, তা হচ্ছে প্রথম কলেমা। এটার নাম কলেমায়ে তৈয়বা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, الم تركيف ضرب الله مثلا كلمة طيبة كشجرة طيبة اصلها ثابت وفرعها فى السماء  ‘অর্থাৎ আপনি কি দেখেন নি যে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘কলেমায়ে তৈয়িবা’ (তাওহীদের পবিত্র বাণী)’র কীরূপ উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন পবিত্র বৃক্ষ, যার মূল (শেকড়) সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, আর শাখা-প্রশাখা আসমানে বিস্তৃত? (সূরা ইবরাহীম:২৪) আমাদের মৌলিক ঈমান তথা তাওহীদ রিসালতের স্বীকৃতির বাণীর বিশেষণ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা প্রয়োগ করেন ‘ত্বায়্যিব’। আর হুযূর কিবলার নাম মুবারক আসমানেই স্থিরকৃত হয় এই শব্দে। পবিত্র কুরআনে এ শব্দের অর্থাৎ طيب এর বিপরীত শব্দে এসেছে خبيث (খাবীস)। যুগে যুগে যারাই তাঁর মৌলিক আক্বীদা-দর্শনের বিপরীতে থাকবে, তাদের পরিচয়ও খাবীস। (সুরা মায়েদার ১০০তম আয়াত দ্র.) অভিন্ন আয়াতটির প্রান্ত টীকায় ‘ত্বায়্যিব’ শব্দের তাফসীরে একাধিক অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। যথা-হালাল, সৎ, মুসলিম, উৎকৃষ্ট। আর এগুলোর বিপরীতে ‘খাবীস’র তাফসীর রয়েছে হারাম, অসৎ, কাফির ও নিকৃষ্ট। তাই সতর্কতার জন্য বলে রাখা সমীচিন যে, যে বা যারা এ শব্দে বা নাম’র এলার্জি বহন করে, তাদের ক্ষেত্রে বিপরিতার্থক অর্থের শব্দগুলো প্রযোজ্য হতে পারে। বিশেষ করে আলোচ্য মহান সত্তার সঠিক আক্বীদা-দর্শন, আমল-আখলাকের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হলে তবে এ প্রযোজ্যতা অনস্বীকার্য।

শৈশব থেকেই হুযূর কিবলার মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা ও অলৌকিক কার্যক্রমের উন্মেষ ঘটে। দুধ ছাড়ানোর যে সয়মটাতে বাচ্চাদের দুধ ছাড়ানো মায়েদের জন্য বিশেষ বিড়ম্বনা ও অস্বস্থির কারণ হয়, খাজা চৌহরভী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর একটিমাত্র উক্তি ‘‘তুম বড়া হো গ্যয়ে, দুধ মাত পিও’’ শোনার পর থেকে তাঁকে আর মায়ের দুধ পান করানো যায়নি। এ বয়সে সাধারণ কোন শিশু আধ্যাত্মিক গুরুজনদের নির্দেশনা মানা প্রমাণ করছে তিনি মাতৃজঠরে বেলায়ত প্রাপ্ত মহান ওলী। তাঁর ৪ (চার) বছর বয়সে শ্রদ্ধেয় আব্বাজানকে করা একটি আবদারের কথা যে কোন শ্রোতাকে তাজ্জব করবে, ‘‘নামাযে মে আপ আল্লাহকো দেখতে হ্যাঁয়, মুঝে ভী দেখনা হ্যায়।’’ হাদীসে জিবরীলে জিবরীল আলায়হিস্ সালামের প্রশ্নের জবাবে পেয়ারা নবীর ইরশাদ اعبد الله كانك تراه অর্থাৎ এমনভাবে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়া, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ।’’ (মিশকাতুল মাসাবীহর কিতাবুল ঈমান’র প্রথম হাদীস দ্র.) এ হাদীস আমরা পরিণত বয়সে হাদীসে পাকের পাঠ নিতে পেরে জেনেছি, মর্মার্থ যথার্থ অনুধাবণ আজ অবধি সম্ভব হয়নি। কিন্তু আল্লাহর আ-রেফ বান্দাগণ সে পাঠ শৈশবেই গভীরভাবে আত্মস্থ করতে সক্ষম হন। শাহিনশাহে সিরিকোট, হুযূর ক্বেবলার পার্থিব জীবনে এমন পাঠের ব্যবহারিক অনুশীলন অলৌকিক!।

এ তো সবে শৈশবের কথা! কারামতের চমক আরম্ভ মাত্র। আল্লাহর অলি-আওতাদ স্বেচ্ছায় প্রদর্শন করেন না। নিজেদের অনিচ্ছায় সমস্ত ক্ষমতার মূল মালিক আল্লাহ্ তা‘আলার অনুমোদনে কিছুটা ঝলক মাত্র সাধারণ মানুষ দেখে। এখানে তাঁর অসংখ্য কারামতের সবগুলো পত্রস্থ করা সম্ভবও নয়। আর এ পরিসরে কারামত বর্ণনা করাও উদ্দেশ্য নয়। তাঁর জীবনী গ্রন্থসমূহে সংশ্লিষ্ট রচয়িতাগণ নিজ নিজ গ্রন্থে অনেকগুলো কারামতের ঘটনাবলী গ্রন্থিত করেছেন। জামেয়ার বর্তমান অধ্যক্ষ মহোদয় আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান (মু.জি.আ.) কৃত জীবনী গ্রন্থে আটাশটি কারামতের ঘটনা সংকলিত হয়েছে। গরীব-নওয়াযের দর্শন লাভ, প্রিয়নবীর যিয়ারত লাভ, এমনকি মুরীদকেও দীদারে মুস্তফার মত অপার্থিব নেয়ামত বখশিশ, নিঃসন্তানকে সন্তান লাভের আশা পূরণ করিয়ে দেওয়া, ক্যান্সার হতে হাজার গুণ শক্তিশালী মরণব্যাধি লিমফোরাম বিষাক্ত যাতনায় তাঁর চেহারা স্বাভাবিক অমলিন থাকা বরং হাসিমুখে এর মরণছোবলকে জয় করে আরো ১৩ বছর জীবনকাল অতিবাহিত করা, পেশাওয়ার হতে সিরিকোট শরীফ যাত্রাকালে নামাযের সময় পেরোতে অলৌকিকভাবে চালকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়ী থেমে যাওয়া ও পরে নির্দেশ অমান্য করায় অনুতপ্ত চালকের ক্ষমা চাওয়া, হুযূর কিবলার খলীফা আলহাজ্ব নুর মুহাম্মদ আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ছাহেবযাদা, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সম্মানিত সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসীন’র ছোটভাই আনিস আহমদ আনিসের ত্রিতল ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গিয়েও হুযূর কিবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহির বিশেষ দুআয় অক্ষত থাকা এমনি জানা-অজানা কত কারামত তাঁর সংঘঠিত হয়েছিল তার হিসাব নিরূপন প্রায় অসম্ভব। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি সেগুলোকে হযরাতে কেরামের দিকে সম্পর্কিত করে নিজেকে আড়াল করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। নিরাভরণের আবরণ বটে!

তাঁর শিক্ষাজীবন ও সাধনা শ্রম, অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সাফল্যে ভরপুর। পিতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক পর্যায়ে তাজভীদসহ (বিশুদ্ধ পঠনরীতি) পবিত্র কুরআন হেফজ (মুখস্তকরণ) সম্পন্ন করেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠের তেলাওয়াত শ্রোতাবৃন্দকে মোহাবিষ্ট করে রাখত। বাংলাদেশে সফরে আসলে প্রথমত, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে তারাভীহর খতম শুনিয়ে মুসল্লীদের মুগ্ধ করেন। কোন বছর পবিত্র রমযানে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ মসজিদ খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ্ খাঁ মসজিদে খতমে তারাভী শোনাতেন।ক্স এরপর শাহেনশাহে সিরিকোট রহমাতুল্লাহি আলাইহির সযত্ন তত্ত্বাবধানে নাহ্ভ, সরফ, উসূল, ফিকাহ্সহ বুনিয়াদী শাস্ত্রসমূহে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন, খাজা চৌহরভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রতিষ্ঠিত হরিপুর রহমানিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় ষোলবছর অধ্যয়নপূর্বক কুরআন, হাদীস, তাফসীর, মান্তিক, আকাইদ, হিকমত, ফালসাফা, আরবী সাহিত্যসহ বহু শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন পূর্বক জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করেন। তাঁর প্রসিদ্ধ শিক্ষকমন্ডলীর মধ্যে হাফেজ আল্লামা আবব্দুর রহমান, হাফেজ আল্লামা আব্দুল হামিদ, বিশেষত যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা সর্দার আহমদ লাইলপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নাম উল্লেখযোগ্য। এরপর সুযোগ্য পিতা ও অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে ইলমে তাসাউফ, তরীকতের মা’রিফাতের নিগুঢ় তত্ত্বজ্ঞান হাসিলের রিয়াযত-সাধনায় ব্রতী হন। ইবাদত-বন্দেগী, যিকর-আযকার, মোরাকাবার সাধনায় সিদ্ধি লাভের মানসে কুতুবুল আউলিয়া শাহিনশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহির পূণ্যহাতে বাইআত হন। এরপর অদম্য রিয়াযত-সাধনায় পীর-মুর্শিদের এবং হযরাতে মাশায়েখে কেরাম’র পূর্ণ আস্থা ও নেক দৃষ্টি অর্জন করেন। ফলে ১৯০৮ খৃ. সনে রূহানী নির্দেশনায় সিরিকোট দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন ও সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক সিলসিলার খলীফায়ে আযমরূপে অভিষিক্ত হন। যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠা দিয়ে শরীয়ত-তরীকতের কার্যক্রম তিনি বহুদূর এগিয়ে নেন। তেত্রিশ বছর একটানা নিরলস সাধনায় তিনি বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। জশনে জুলুসের প্রবর্তন, গাউসিয়া কমিটি গঠন, মাসিক পত্রিকা তরজুমানে আহলে সুন্নাত’র মত সুন্নিয়তের মুখপত্র প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি বিপ্লবধর্মী সংস্কারমূলক প্রজ্ঞার বিস্ময়কর স্মারক। তাঁর সাংগঠনিক দূরদর্শিতা আদর্শিক প্রতিপক্ষের লোকেরা পর্যন্ত বিনা দ্বিধায় স্বীকার করে। এক সত্তায় বহু মাত্রিকতার নজীর।

এতবড় মাপের রাহনুমা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আচার-আচরণ ছিল অতি সহজ সরল। ভন্ডামী, প্রতারণা, শঠতা, মিথ্যাচার, কপটতা, তোষামোদ এগুলোকে তিনি শুধু বর্জনই নয়; বরং ঘৃনা করতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন আখলাকে মুস্তফার দর্পণ। এমন পীরের জন্যই বুঝি আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সালাম রচিত হয়, ‘‘জিনকে হার হার আদা সুন্নাতে মুস্তফা’’। অতিথির অবস্থান যাই হোক তার প্রতি মুর্শিদ কিবলার অকুণ্ঠ মমতা ও সযত্ন তদারকি কী পরিমাণ তাঁর কাছে না গেলে কেউ তা বুঝে উঠতে পারবে না। আমি নিজে ১৯৯২ইং সনে আমার এ রূহানী রাহনুমার খেদমতে হাজির হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার সহপাঠি মাওলানা সৈয়দ হোসাইন তখন করাচী থাকতেন। আমি তাঁর ঠিকানায় প্রথম উপস্থিত হই। তিনি আমাকে বন্ধু সুলভ ব্যবহারে প্রীত করেছেন। তাঁর সঙ্গে পেশাওয়ার খাইবার হাসপাতালে প্রাণপ্রিয় মুর্শিদের দর্শন লাভে ধন্য হয়েছি। শুধু জামেয়ার ছাত্র জেনেই আমার প্রতি কী পরিমাণ স্নেহ মমতায় সিক্ত করেছেন তা ভাবলে নিজকে এত সুখী মনে হয়, যা প্রকাশ করতে আমার কোন ভাষা নেই। মুর্শিদের কথার জবাব দেবার মত উর্দুতে তেমন পারঙ্গমতা নেই। সৈয়দ হোসেন সাহেব আমাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছিলেন। পরের দিনই আমরা মুর্শিদে বরহকের অনুমতি নিয়ে সিরিকোট শরীফ যিয়ারতে যাই। যদ্দূর মনে পড়ে পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সায়্যিদ ছাবের শাহ্ (মু.জি.আ.)’র নির্দেশে আমাদের জন্য এমপি হোস্টেলে একটা রুম বরাদ্দ হয়, যেখানে আমরা অবস্থান করেছিলাম। কামিল সম্পন্ন করেছি জেনে জামেয়ার ফারেগ এ অভাজনকে হুযূর কিবলা দ্রুত দেশে ফিরে জামেয়ার শিক্ষকতায় ইলমে দ্বীন’র খেদমতের নির্দেশ দেন। জরুরী নসীহতও রাখেন। আমি ভাবছি, এ পেশা তো দারিদ্রের সমার্থক। আমি দেশ ছেড়েছিলাম ধান্ধায়! কী করতে পারি? আমার মনের কথা মুর্শিদে বরহকের অগোচরে রইল না। এটা আমি মুখে নয়, মনে এনেছিলাম। তিনি বললেন, ‘‘এটা মহান খেদমত, কাজে লেগে গেলে সব প্রয়োজন আল্লাহর পক্ষ থেকে মেটানো হবে।’’ আসার সময় আমরা লাহোর হয়ে ফিরবো। তিনি এরশাদ করলেন, ‘‘লাহোরে গিয়ে হোটেলে নয়, হাজী রউফ ভাইয়ের বাসভবনে উঠবে, বলবে তোমরা আমার মেহমান, থাকা-খাওয়ার অর্থ সাশ্রয় হবে, উনিও খুশী হবেন।’’ ওখানে পৌঁছে আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। কারণ, কাশফ ও কারামতের অধিকারী আল্লাহর ওলীগণের কথার রহস্য বুঝা দায়। রাউফ সাহেব পীর অন্তপ্রাণ একজন পীর ভাই। শুধু তিনি নয়, তাঁর পুরো পরিবার। তাঁর মুখে যা শুনলাম, তাতেই আমাদের বিস্ময়। তিনি আমাদের যা আপ্যায়ন করলেন, নিকট আত্মীয়কেও কেউ তেমন সমাদর করবে না। শুনেছি তাঁর স্ত্রী ও হুযূর কিবলার খেদমতের জন্য উতলা। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা একদিন আগেই বলাবলি করেছি যে, কোন কারণে হয়তো হুযূর ক্বেবলা আমাদের প্রতি নারাজ হয়েছেন। অনেকদিন যাবৎ তিনি আমাদের কাছে কোন মেহমান পাঠাচ্ছেন না। আপনাদের পাঠানোয় আমাদের সে শঙ্কা কেটে গেছে। তিনি আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন।’’ সে কি রাজ অতিথির মেহমানদারী কপালে জুটেছে মুর্শিদের দয়ায়।
সহযাত্রী বন্ধু, (যিনি করাচীতে আমার মেজবান ছিলেন) সৈয়দ ভাই আমাকে লাহোর এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেন। উল্লেখ করা দরকার, এটাও হুযূর কিবলারই নির্দেশ ছিল সৈয়দ ভাইয়ের প্রতি যে, ‘‘তুমি একে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ছেড়ে আসবে।’’ আর বার বার মনে পড়ছিল, পিতৃসুলভ স্নেহ মাখা কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, তুমি মুসাফির, রাহ খরচ সীমিত, হোটেলে ওঠে, কিনে খেয়ে টাকাগুলো খরচ করে ফেলো না, রাউফ সাহেবের বাসভবনে ওঠো।’’ এয়াপোর্টের বিদায়ের মুহূর্তে প্রবাসী বন্ধুর সজল চোখ এখনও মনে পড়ে। কোনদিন ভুলতে পারবো না, অভাজন মুরীদ এ নালায়েকের প্রতি মুর্শিদের এমন সযত্ন দৃষ্টি, এ রূপ স্নেহমাখা আতিথেয়তা! আল্লাহর রসূলের হাদীস শরীফ মনে পড়ছে, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি যথার্থ বিশ্বাসী, সে যেন তার অতিথির সমাদর করে।’ সুন্নাতে রাসূল’র জীবন্ত রূপ তো আওলাদে রসূলই হবেন। আর আমাদের সৌভাগ্যও কেমন ঈর্ষনীয়! তাঁর চরণে নিবেদিত স্বরচিত কয়েকটি বাংলা মানকাবাত হতে দু’টি পংক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে এলোমেলো কথার ইতিটানি-
‘‘তোমার দামান যেই না ধরেছি,
হৃদয় ছিঁড়েছে তখনই জেনেছি,
এলো না যে এই দামান ধরতে,
বুঝেনি সেই জন আমরা বুঝেছি।’’