হাদীস শরীফের আলোকে মাদানী চাঁদ
সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
খাতামুুল আম্বিয়া (সর্বশেষ নবী)
সম্মানিত পাঠক সমাজ!
মাদানী চাঁদ, আল্লাহর প্রিয়তম, আরশে মু‘আল্লার নক্ষত্র হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। তাঁর পরে কোন প্রকারের কোন নবী (কিংবা স্বতন্ত্র, অধীনস্থ, বরূযী যিল্লী) আসতেই পারে না। এর অকাট্য প্রমাণ ক্বোরআনে মজীদ ফোরক্বানে হামীদ থেকে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে হাদীস শরীফ থেকে এ নিবন্ধেও ইতোপূর্বে দেওয়া হয়েছে। এর উপর আরো বহু হাদীস শরীফও সাক্ষী রয়েছে। সংক্ষেপে ওইগুলো থেকে নি¤েœ আরো কয়েকটা হাদীস শরীফ উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
হাদীস শরীফ-১
ইমাম তিরমিযী ও আবূ দাঊদ সাইয়্যেদুনা হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, সাইয়্যেদুল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
سَيَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ كَذَّابُوْنَ ثَلثُوْنَ كُلُّهُمْ يَزْعَمُ اَنَّه نَبِىُّ اللهِ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ –[مشكوة شريف : صفحه : ৪৬৫]
অর্থ: নিশ্চয় আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মহামিথ্যাবাদী দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। তাদের প্রত্যেকে মনে করবে যে, সে আল্লাহ্ তা‘আলার নবী; অথচ আমি হলাম আখেরী নবী। আমার পর কোন নবী আসবে না।
পর্যালোচনা
এ হাদীস শরীফে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে নি¤œলিখিত বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়- প্রথমত, ফখরে দু’ আলম তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, তাঁর পর নিরেট মিথ্যা ও ভন্ড নুবূয়তের দাবীদারই আত্মপ্রকাশ করবে; কিন্তু কোন নবী পয়দা হবে না। নবূয়ত আমারই উপর সমাপ্ত করা হয়েছে।
অসম্ভব কল্পনায়, যদি কোন প্রকারের নুবূয়ত অবশিষ্ট থাকতো, তবে এভাবে এরশাদ হতো, ‘আমার পর নবীও আসবে, দাজ্জাল-কায্যাবও আসবে; যদি নবী তাশরীফ আনে, তবে তাঁর আনুগত্য করবে, আর যদি দাজ্জাল ও কায্যাব (মহামিথ্যুক) আসে, তবে তার খপ্পর থেকে বাঁচবে। কিন্তু সরকার-ই মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন উম্মতকে শুধু এ হিদায়ত করেছেন যে, ‘‘যে কেউ আমার পরে নুবূয়তের দাবী করবে, তাহলে নির্দ্বিধায় তোমরা তাকে দাজ্জাল ও কায্যাব মনে করবে।’’ এটা এ কথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, এখন সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন প্রকারের নুবূয়ত অবশিষ্ট নেই। হুযূর-ই আক্রাম-ই সর্বশেষ নবী। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি সমস্ত জগতের মালিক, প্রতিপালক।
দ্বিতীয়ত, ওই দাজ্জাল ও কায্যাব শেষ যামানার নবীর উম্মত তথা মুহাম্মদী হবারও দাবী করবে। যেমনটি سَيَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ كَذَّابُوْنَ (অবিলম্বে আমার উম্মতের মধ্যে মহামিথ্যাবাদীগণ আত্মপ্রকাশ করবে) থেকে বুঝা যায়। বস্তুত ‘মুহাম্মদী’ ও ‘উম্মত’ হবার দাবীও এ জন্য করবে যে, যদি তারা হুযূর-ই আক্রামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের নুবূয়তের ঘোষণা দেয়, তবে কেউই তাদের ধোঁকা ও প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়বে না। এ কারণে, তারা নিজেদেরকে হুযূর-ই আক্রামের সাথে সম্পৃক্ত বলে দেখাবে। তারপর তারা এ ধোঁকা ও প্রতারণার সাথে লোকজনের সামনে তাদের মিথ্যা নুবূয়তের দাবী পেশ করবে; যেমন মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী দাহ্ক্বানী করেছে। প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের আক্বা ও মাওলা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ইলমে ছিলো যে, মির্যা ক্বাদিয়ানী নিজে নিজেকে তাঁর দিকে সম্পৃক্ত করে লোকজনকে ধোঁকা দিয়ে নুবূয়তের দাবী করবে।
তৃতীয়ত, মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওই কায্যাব বা মিথ্যা দাবীদার মির্যা ক্বাদিয়ানী ভন্ড নবী হবার প্রমাণ এটাও বর্ণনা করেছেন যে, ‘সে একথার ধারণা করবে যে, সে নবী; অথচ আমিই সর্বশেষ নবী।’ সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, দাজ্জাল ও কায্যাব হবার জন্য শুধু নুবূয়তের দাবীদার হওয়াই যথেষ্ট। অন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজন হবে না। কাজেই, মির্যা ক্বাদিয়ানী মিথ্যাবাদী হবার জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নুবূয়তের দাবী করেছে।
চতুর্থত, لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ ইবারতটা اَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ-এর তাফসীর বা ব্যাখ্যা। আর لاَ পদটি نفى جنس -এর, যা نكره -এর উপর আসে; যার মর্মার্থ হয়, ‘আমার পরও এ جنس (জাতি)টাই খতম হয়ে গেছে। جنس نبى (নবী নামক জাতি)’র কোন ব্যক্তিই আমার পর মওজূদ থাকবে না। আর যেহেতু ‘নবী’ শব্দটি عام (ব্যাপকার্থক), চাই শরীয়ত বিশিষ্ট বলে দাবীদার হোক কিংবা কারো অনুগামী হোক আর رسول (রসূল) শব্দটি খাস, তাই রসূলে মু‘আয্যম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম مطلق نبى (শর্তহীনভাবে নবী)’র অস্বীকৃতি এরশাদ করেছেন, অর্থাৎ আমার পর কোন নবী আসবে না, চাই সে শরীয়ত বিশিষ্ট বলে দাবী করুক কিংবা শরীয়তবিহীন বলে দাবী করুক। কেননা, শরীয়ত বিশিষ্ট ও শরীয়তবিহীন مطلق نبى (শর্তহীন নবী) শব্দের বিভিন্ন প্রকার। আর যখন মৌলিকভাবে مُقَسَّمْ (যার প্রকারভেদ করা হয়)-এর অস্তিত্বই থাকবে না, তখন সেটার প্রকারগুলো কোত্থেকে আসবে? আর ‘মানতিক্ব’ বা যুক্তিশাস্ত্রের নিয়ম আছে যে, اقسام (প্রকারগুলোর)’র অস্তিত্ব مُقَسَّمْ (যার প্রকারভেদ করা হয়) ব্যতীত এবং افراد (ব্যক্তিগুলো)’র অস্তিত্ব كُلِّىْ (যার অধীনে ব্যক্তিগুলো আছে)-এর অস্তিত্ব ব্যতীত যুক্তিগত দিক (عقلاً) দিয়েও অসম্ভব। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী চাই স্বতন্ত্র নবী হবার দাবী করুক অথবা অধীন নবী, যিল্লী কিংবা বরূযী নবী হবার দাবী করুক, সরকারে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত হাদীস শরীফের আলোকে মহা মিথ্যুকই।
পঞ্চমত, এ হাদীস শরীফ থেকে এতটুকু সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’ মানে ‘আখেরী নবী’। এর এ অর্থ নয় যে, তিনি সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর নিছক মোহর ও সৌন্দর্য (শোভা)। এ জন্য হাদীস শরীফের এ বাক্য, তিনি নুবূয়তের দাবীদারগণ মিথ্যুক হবার দলীল হিসেবে এরশাদ করেছেন যে, ওইসব নুবূয়তের দাবীদার মিথ্যুক হবার দলীল এ যে, ‘‘আমি খাতামুন নবিয়্যীন’, আমার পরে কোন নবী নেই।’’ সুতরাং তাদের নবী হবার দাবীই তাদের মিথ্যুক হবার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
অতঃপর যদি ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ ‘মোহর’ কিংবা ‘শোভা’ নেওয়া হয়, তবে সেটাকে ওইসব ভন্ড দাবীদার মিথ্যুক হবার প্রমাণ কীভাবে দাঁড় করানো যাবে? বরং তখন হাদীস শরীফের অর্থ, ‘আমার পর অনেক মিথ্যুক (কায্যাব) ও দাজ্জাল নুবূয়তের দাবী করবে; অথচ আমি নবীগণের মোহর। আমার মোহর দ্বারা নবী হবে।’ সুতরাং একথা সুস্পষ্ট হলো যে, এ অর্থ অকেজো; ‘লা নবিয়্যা বা’দী’ (আমার পরে কোন নবী নেই)-এর সুস্পষ্ট বিরোধী ও এর সাথে সাংঘর্ষিক; বরং ‘আনা খাতামুন্ নবিয়্যীন’ (আমি সর্ব শেষ নবী)-এর পর ‘লা-নবিয়্যা বা’দী’ (আমার পর কোন নবী নেই) বর্দ্ধিত করা এ বিষয়ের পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, এখানে ‘খাতাম’ মানে ‘মোহর’ নয়; বরং ‘আখির’ (সর্বশেষ)। অতএব, মির্যা ক্বাদিয়ানী তার নবী হবার দাবীতে কায্যাব বা মহা মিথ্যুক।
হাদীস শরীফ-২
ইমাম বোখারী ও মুসলিম সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেন-
مَثَلِىْ وَمَثَلُ الْاَنْبِيَآءِ كَمَثَلِ قَصَرٍ اُحْسِنَ بُنْيَانُه تُرِكَ مِنْهُ مَوْضَعُ لَبِنَةٍ فَطَافَ بِهِ النَّظَّارُ يَتَعَجَّبُوْنَ مِنْ حُسْنِ بُنْيَانِه اِلاَ مَوْضَعَ تِلْكَ اللَّبِنَةِ فَكُنْتُ اَنَا سَدَدْتُ مَوْضَعَ اللَّبِنَةِ خُتِمَ بِىَ الْبُنْيَانُ وَخُتِمَ بِىَ الرُّسُلُ وَفِىْ رِوَايَةٍ فَاَنَا اللَّبِنَةُ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيَّيْنَ –[رواهُ الْبخارى ومسلم والمشكواة صفحه ৫১১]
অর্থঃ আমার ও পূর্ববর্তী নবীগণের উপমা এমন এক অট্টালিকার মত, যাকে অতি সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু তাতে একটি মাত্র ইটের জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর পরিদর্শনকারীরা তা ঘুরে ঘুরে দেখে এবং সেটার সৌন্দর্য নিয়ে আশ্চর্যবোধ করে; কিন্তু ওই ইটের স্থান দেখে (হতবাক হয়)। সুতরাং আমি ওই ইটের জায়গাটুকু পূর্ণ করে দিয়েছি। আর ওই অট্টালিকা আমার দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে এবং রসূলগণের আগমনের ধারাও আমার উপর সমাপ্ত হয়েছে। অন্য এক বর্ণনা এসেছে, (হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করেছেন) ‘‘আমি (নুবূয়তের অট্টালিকার সর্বশেষ) ইট, আমি নবীগণের আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। [বোখারী, মুসলিম, মিশকাত-পৃ. ৫৫১]
হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা
প্রত্যেক বস্তুর একটা আরম্ভ আছে এবং একটি শেষ। এভাবে নুবূয়তরূপী ইমারতেরও একটি শুরু এবং একটি শেষ আছে। এ দুনিয়ায় ওই ইমারতের আরম্ভ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর মাধ্যমে হয়েছে আর সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে এ ইমারত সমাপ্ত বা পূর্ণাঙ্গ হয়েছে। একটি মাত্র ইট নুবূয়তের অট্টালিকার পরিপূর্ণতার জন্য অবশিষ্ট ছিলো। তাঁর প্রশংসিত স্বত্তা ওই জায়গা পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। সুতরাং এভাবে নুবূয়তরূপী অট্টালিকা একেবারে পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে। এখন তাতে কোন ইট সংযোজনের জায়গা বাকী নেই যে, তাতে কোন শরীয়তধারী কিংবা শরীয়তবিহীন নুবূয়তের ইট প্রবেশ করতে পারবে। আফিমখোর গ্রাম্য অশিক্ষিত গোঁয়ার মির্যা ক্বাদিয়ানী ওই নুবূয়তরূপী অট্টালিকায় একটি ইট প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তাতে আর কোন জায়গায়ই নেই। সুতরাং যেহেতু মির্যা কাদিয়ানীরূপী ওই তথাকথিত ইটটি নুবূয়তরূপী অট্টালিকার অংশ হবার কোন সুযোগ নেই, সেহেতু সেটাকে অন্য কোথাও ছুঁড়ে মারা হবে বৈ-কি?
গভীরভাবে চিন্তার বিষয় যে, যখন মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহেবযাদাগণ, সাইয়্যেদুনা হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর, হযরত ফারূক্বে আ’যম এবং সাইয়্যেদুনা হযরত ওসমান এবং হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর জন্য নুবূয়তরূপী অট্টালিকায় কোন প্রকারের অবকাশ খোঁজা হয়নি, তখন মুসায়লামাতুল হিন্দ ও আসওয়াদ-ই ক্বাদিয়ানীর জন্য কোত্থেকে জায়গা বের করা যাবে? অবশ্য কুফর ও দাজজাল (কাফির ও দাজ্জাল) রূপী বালাখানায় ওই আফীমী ক্বাদিয়ানীকে এক কোণে একটি ইটের মতো ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
আফসোস শত আফসোস যে, শাহে আরব ও আজম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তো সুস্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ্ সুবহা-নাহু ওয়া তা‘আলা নুবূয়তরূপী অট্টালিকা (ইমারত)কে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন; কিন্তু মির্যা ক্বাদিয়ানী প্রলাপ বকছে যে, ‘না, এখনো নুবূয়তের অট্টালিকা অসম্পূর্ণ রয়েছে, তাতে আরো অনেক ইট সংযোজনের অবকাশ রয়েছে।’ না‘ঊযুবিল্লাহ্! সুম্মা না‘ঊযুবিল্লাহ্!
হাদীস শরীফ-৩
ইমাম মুসলিম সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, হুযূর সাইয়্যেদুল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
فُضِّلْتُ عَلَى الْاَنْبِيَآءِ بِسِتٍّ اُعْطِيْتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَاُحِلَّتْ لِىَ الْغَنَآئِمُ وَجُعِلَتْ لِىَ الْاَرْضُ مَسْجِدًا وَطُهُوْرًا وَاُرْسِلْتُ اِلَى الْخَلْقِ كَآفَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّوْنَ -থ[رَوَاهُ مُسْلِمٌ وَالْمِشْكواة ـ صفحه ৫১২]
অর্থঃ আমাকে সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম-এর উপর ছয়টি জিনিস দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছেঃ ১. আমাকে ‘জামি‘ই কলেমাত’ (ব্যাপক অর্থ বিশিষ্ট বাণীসমূহ) দান করা হয়েছে, ২. আতঙ্ক দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, ৩. আমার জন্য গণীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) হালাল করা হয়েছে, ৪. আমার জন্য গোটা যমীনকে মসজিদ ও পবিত্রকারী বানানো হয়েছে, ৫. আমাকে সমস্ত সৃষ্টির প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে এবং ৬. আমাকে সর্বশেষ নবী করা হয়েছে; নুবূয়তের ধারা আমার মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়েছে। [মুসলিম, মিশকাত, পৃ. ৫১২]
হাদীস শরীফ-৪
ইমাম দারেমী সাইয়্যেদুনা হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, মাহবূবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَنَا قَائِدُ الْمُرْسَلِيْنَ وَلاَ فَخْرَ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ وَلاَفَخْرَ
وَاَنَا اَوَّلُ شَافِعٍ وَمُشَفَّعٍ وَلاَ فَخْرَ ـ [رواه الدرامىُ وَالْمِشْكواةُ صفحه : ৫১৪]
অর্থঃ আমি সমস্ত রসূলের ক্বা‘ইদ (পরিচালনাকারী) আর একথা নিছক গর্বের নয় (বরং বাস্তব), আমি সমস্ত নবীর আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। আর এটা নিছক গর্ব-অহংকারের কথা নয় এবং আমি প্রথম সুপারিশকারী ও আমার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য; আর এটাও নিছক গর্ব অংহকারের কথা নয়। [দারেমী, মিশকাত, পৃ. ৫১৪]
উক্ত হাদীস দু’টির সারকথা
উপরিউক্ত অতি উঁচু মানের দু’টি হাদীস শরীফ থেকে একথা মধ্যাহ্ণ সূর্যের মতো স্পষ্ট হয়েছে যে, মানব-দানবের সরদার, মাহবূবে রব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন খাতামুল আম্বিয়া আর নবীগণের শুভাগমনের সিলসিলা (ধারা) তাঁরই দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে। এখন তাঁরই নুবূয়ত ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে।
আশ্চর্যবোধ হয় মির্যাঈ ফির্ক্বার উপর, এতগুলো স্পষ্ট বর্ণনার পরও গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীকে তারা তাদের নবী বলে মান্য করে। হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুস্পষ্ট অর্থবোধক হাদীস শরীফগুলোকে অস্বীকার করছে। আরো আশ্চর্যের কথা হচ্ছে তারা সরকার-ই মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হবারও দাবীকে বহাল রাখছে। لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ (মিথ্যা দাবীদারদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত অবধারিত)।
হাদীস শরীফ-৫
হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমায়েছেন-
لَوْكَانَ بَعْدِىْ نَبِىٌّ لَكَانَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ
অর্থ: ‘যদি আমার পরে কোন নবী হতো, তবে অবশ্যই ওমর ইবনে খাত্তাবই হতো।’ [তিরমিযী, মিশকাত, পৃ. ৫৫৮]
হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা
এ হাদীস শরীফ থেকে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রিসালাতের সূর্য হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। অর্থাৎ তাঁর পরে আর কোন নবী পয়দা হবে না। কেননা, হাদীস শরীফে لو শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর ‘বালাগাত’ ও আরবের পরিভাষায় لَو শব্দটি অসম্ভব বিষয়াদি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন নি¤œলিখিত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান-لَوْكَانَ فِيْهِمَا الِهَةٌ اِلاَّ اللهُ لَفَسَدَتَا
তরজমা: যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ্ ব্যতীত আরো ইলাহ্ থাকতো, তবে সে দু’টি ধ্বংস হয়ে যেতো। [সূরা আম্বিয়া: আয়াত-২২]
অন্য আয়াতে এরশাদ করেন-
قُلْ لَوْكَانَ مَعَه الِهَةٌ كَمَا يَقُوْلُوْنَ اِذًا لاَ بْتَغَوا اِلى ذِى الْعَرْشِ سَبِيْلاً
তরজমা: আপনি বলুন, ‘যদি তাঁর সাথে আরো খোদা থাকতো যেমন এরা বকছে, তবে তারা আরশ অধিপতির দিকে কোন পথ খুঁজে বের করতো।’ [সূরা ইসরা: আয়াত-৪২, কানযুল ঈমান]
পক্ষান্তরে, সম্ভব বিষয়াদির জন্য اِنْ (যদি) এবং اِذَا (যখন) ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এ হাদীস শরীফে لو শব্দের ব্যবহার বুঝায় যে, হুযূর আপদমস্তক শরীফ নূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবী আসা অসম্ভব (محال)। এ কারণে এগুলো অসম্ভব কল্পনায় (بطور فرض محال) বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ যদি আমার পর নবী আসা সম্ভবপর হতো, তবে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)ই হতো; কিন্তু আমার পর কোন প্রকারের নবী হতে পারে না।
সুতরাং যদি মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন প্রকারের নুবূয়ত বাকী থাকতো, তবে সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য তা অবশ্যই সাব্যস্ত হতো। কারণ, খোদ সরওয়ার-ই দু’ আলম তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সাইয়্যেদুনা ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ‘ফারূক্ব’, ‘মুহাদ্দিস মিনাল্লাহ্’ এবং ‘মুতাকাল্লিম বিস্ সাওয়াব’-এর মতো সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেছেন। সুতরাং যদি নুবূয়তের ধারা জারী থাকতো তবে সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অবশ্যই নবী হতেন। যখন এমন বুযুর্গ ব্যক্তি নবী হতে পারেননি, তখন এক কাদিয়ানী ও গ্রাম্য মুর্খ ব্যক্তি কিভাবে নবী পেতে পারে?
হাদীস শরীফ-৬
ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিম সাইয়্যেদুনা হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্বক্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণনা করেন, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদুনা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে এরশাদ করেছেন-
اَنْتَ مِنِّىْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُّوْسى اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ
[بخارى ـ مسلم ـ مشكوة ـ صفحه ـ ৫৬৩]
অর্থঃ তোমার সাথে আমার ওই সম্পর্ক রয়েছে, যা (সাইয়্যেদুনা) হযরত হারূনের হযরত মূসার সাথে ছিলো; কিন্তু আমার পরে কোন নবী নেই। (আলায়হিমুস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম)
হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা
সব জ্ঞানীই জানে যে, সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম স্বতন্ত্র নবী ছিলেন না বরং হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর উজির ও তাঁর অনুগামী ছিলেন; যেমন ক্বোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- (হযরত মূসা ফরিয়াদ করছিলেন)
وَاجْعَلْ لِىْ وَزِيْرًا مِّنْ اَهْلِىْ هَارُوْنَ اَخِىْ [سورة طه : ايت ـ২৯-ـ৩০]
তরজমাঃ ২৯।। এবং আমার জন্য আমার পরিবারবর্গের মধ্য থেকে একজনকে উযীর করে দাও। ৩০।। সে কে? আমার ভাই হারূন। [সূরা ত্বোয়াহা: আয়াত-২৯-৩০, কানযুল ঈমান]
এ কারণে সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম তাওরীত ও হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর শরীয়তের অনুসারী ছিলেন; যদিও মূল নুবূয়তের মধ্যে উভয়ে শরীক ছিলেন। মোটকথা, সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম দু’টি জিনিষের অধিকারী ছিলেনঃ ১. তিনি হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে নুবূয়তে শরীক ছিলেন এবং ২. তিনি তাঁর উজীর ও নায়েব (প্রতিনিধি) ছিলেন। শাহানশাহে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাবূকে তাশরীফ নিয়ে যাবার সময় যখন সাইয়্যেদুনা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে একথা বলেছিলেন, ‘‘আমি চলে যাবার পর তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে, যেমনিভাবে সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন, যখন হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম তূর পর্ব্বতে তাশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, কেউ যেন ভুল না বুঝে, তজ্জন্য সাথে সাথে একথাও বলেছিলেন- اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ(তবে আমার পরে কোন নবী নেই)। অর্থাৎ তুমি শুধু আমার প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হয়েছো, নবী হওনি। হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে তোমার শুধু স্থলাভিষিক্ত ও নায়েব হবার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে; কিন্তু নুবূয়তের মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই। কারণ, আমার পরে কোন নবী আসতে পারে না। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ -এর মধ্যে হযরত আলী অধীনস্থ নবী হওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ হযরত আলী মুরতাদ্বার জন্য স্বতন্ত্র নবী হবার কথা বিন্দুমাত্র কল্পনাও করা যায় না। আবার বিশেষত সাইয়্যেদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতি ও জীবদ্দশায় কার মধ্যে এ সন্দেহ বা আশঙ্কা থাকতে পারে যে, সাইয়্যেদুনা হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীমকে আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র কিতাব ও স্বতন্ত্র শরীয়ত দান করা হবে? এবং স্বাধীনভাবে তাঁর উপর আল্লাহ তা‘আলার ওহী আসতে শুরু করবে? তাছাড়া স্বতন্ত্র নবীর কারো স্থলাভিষিক্ত হওয়া তো তাঁর স্বতন্ত্র হবার পরিপন্থী (বিরোধী)!
এখন এ বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট হলো যে, اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (তবে আমার পরে কোন নবী নেই)-এর মধ্যে অধীনস্থ নবী হবার কথাও অস্বীকার করা হয়েছে মর্মে বুঝা যায়, যার মির্যা ক্বাদিয়ানী দাবী করছে। সুতরাং ক্বাদিয়ানী কর্তৃক ‘অধীনস্থ নবী’ হবার দাবী করাও সম্পূর্ণ বাতিল ও অনর্থক হলো।
মির্যা ক্বাদিয়ানীর ধোঁকা
মির্যা ক্বাদিয়ানী কখনো নিজেকে ‘যিল্লী নবী’ (ছায়া নবী) বলে দাবী করেছিলো, কখনো ‘বরূযী নবী’ বলে দাবী করতো, যাতে সাধারণ ও সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে এ ধোঁকায় ফেলতে পারে যে, তার নুবূয়ত তো খাতামুন্ নবিয়্যীন সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধী নয়! অথচ যিল্লী (ছায়া), রূপক ও বরূযী নুবূয়তের পরিভাষাগুলো নিছক মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীরই আবিষ্কার; কিতাব, সুন্নাহ, সাহাবা-ই কেরামের অভিমতগুলো এবং সলফে সালেহীনের মধ্যে কোথাও এর নাম-নিশান পর্যন্ত নেই। কোন প্রকারের নুবূয়তেরও যদি কোন দরজা খোলা থাকতো, তবে ওইসব পবিত্র মনের ব্যক্তিদের জন্য খোলা হতো, যাঁরা নুবূয়তের প্রদীপের উপর পতঙ্গের ন্যায় গিয়ে পড়তেন এবং তাঁর ইশক্ব ও মুহাব্বতের মধ্যে এমনই নিমজ্জিত ও বিলীন ছিলেন যে, পূর্ব ও পরবর্তীদের মধ্যে কোথাও এর নযীর নেই। সুতরাং যেভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নুবূয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে, তেমনি তাঁর উপর মাহবূবিয়াত (আল্লাহর খাস বন্ধু হবার মর্যাদা) সমাপ্ত হয়েছে। সুতরাং না আসমান ও যমীন এমন ‘মাহবূব’ দেখেছে, না এমন আশিক্ব ও প্রাণ উৎসর্গকারী দেখেছে, না এমন নুবূয়ত-প্রদীপ দেখেছে, না এমন পতঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
যদি কোন প্রকার নুবূয়তের দরজাও খোলা থাকতো, তবে ওই ইয়ারে গার, রফীক্বে জাঁ-নেসার হযরত আবূ বকর, যাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা আপন কিতাবে মুবীনে ‘সানী-ই ইসনা‘ঈন’ (দু’জনের দ্বিতীয়), ‘আত্বকা’ ও উলুল ফদ্বল’-এর মতো উপাধিতে ভূষিত করেছেন, এর জন্য খোলা থাকতো। তখন তিনি তথাকথিত ‘যিল্লী’ কিংবা ‘বরূযী’র মতো কোন না কোন নুবূয়ত তো অবশ্যই পেয়ে যেতেন। অথবা হযরত ওমর ফারূক্বের জন্য নবূয়তের দরজা খুলে যেতো। কেননা, সরওয়ারে দু’ আলম সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁরা দু’জনকেই নিজের উজির বলেছেন। যেমন হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলে খোদা সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَامِنْ نَبِىٍّ اِلاَّ وَلَه وَزِيْرَانِ مِنْ اَهْلِ السَّمَآءِ وَوَزِيْرَانِ مِنْ اَهْلِ الْاَرْضِ فَاَمَّا وَزِيْرَاىَ مِنْ اَهْلِ السَّمَآءِ فَجِبْرَائِيْلُ وَمِيْكَائِيْلُ وَاَمَّا وَزِيْرَاىَ مِنْ اَهْلِ الْاَرْضِ فَأَبُوْ بَكْرٍ وَعُمَرُ ـ [ترمذى : مشكوة صفحه ـ ৫৬০]
অর্থঃ এমন কোন নবী নেই, যাঁর দু’জন উজির আসমান থেকে এবং দু’জন উজির যমীনবাসীদের থেকে নেই। সুতরাং আসমানগুলো থেকে আমার দু’জন উজির হচ্ছে- হযরত জিব্রাঈল ও হযরত মীকাঈল (আলায়হিমাস্ সালাম) আর যমীনবাসীদের থেকে আমার দু’জন উজির হচ্ছেন (হযরত) আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও (হযরত) ওমর ফারূক (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা)।
এ হাদীস শরীফ থেকে বুঝা গেলো যে, সাইয়্যেদুনা সিদ্দীক্বে আকবার ও সাইয়্যেদুনা ফারূক্বে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা হলেন যমীনে হযরত জিব্রাঈল ও হযরত মীকাঈলের নমুনা এবং হুযূর-ই আক্রামের কর্ম ব্যবস্থাপনার উজিরদ্বয়; কিন্তু কোন প্রকারের নবী নন। যদি, অসম্ভব কল্পনায়ও তাঁরা নবী হতেন, তবে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুগামী ও উম্মতই হতেন; কিন্তু এ দু’জন হযরতকে তো নবী বলেন নি; কেননা, নুবূয়তের ধারা একেবারে খতমই হয়ে গিয়েছিলো। মোটকথা, যখন হযরত জিব্রাঈল ও মীকাঈলের ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বদ্বয় নবী হননি, তখন কি মির্যা ক্বাদিয়ানীর মতো শয়তান আযাযীলের দোসর নবী হতে পারে? মোটেই না।
—০—
খতমে নুবূয়তের উপর সাহাবা-ই কেরাম
এবং সলফে সালেহীনের ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত
সাহাবা-ই কেরামের নিকট খতমে নুবূয়তের গুরুত্ব
খতমে নুবূয়তের মাসআলায় সমস্ত সম্মানিত সাহাবী আলায়হিমুর রিদ্বওয়ান একমত। কোন সাহাবীর এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। অনেক নির্ভরযোগ্য শীর্ষস্থানীয় সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম খতমে নুবূয়তের অগণিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)-এর খিলাফতামলের শুরুতে অনেক লোক ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ্দ্ হয়ে গিয়েছিলো। এ নাজুক সময়ে কিছুলোক এ অবস্থাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে ভন্ড নুবূয়তের দাবীদার হয়ে বসেছিলো। যেমন-সাজাহ্ বিনতে হারিস, যে এক ইহুদী গণক নারী ছিলো। সে নুবূয়ত দাবী করেছিলো। একটি জনগোষ্ঠী তার এ মিথ্যা দাবীকে সত্য বলে বিশ্বাসও করেছিলো। এভাবে আস্ওয়াদ আনাসী, যে ইয়ামনের বাসিন্দা ছিলো, ভন্ড নুবূয়তের দাবীদার হয়ে বসেছিলো, অনুরূপ মুসায়লামা কায্যাবও, যে ইয়ামামাহর বাসিন্দা ছিলো, নবী বলে দাবী করেছিলো এবং তার খুব চর্চাও হচ্ছিলো।
খলীফাতুল মু’মিনীন সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুকুম জারী করলেন যেন সর্বপ্রথম ওই বানোয়াট ও ভন্ড নবীদের দমন করা হয়। তখন আস্ওয়াদ আনাসী, মতান্তরে তাওবা করে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়; কিন্তু মুসায়লামা কায্যাব ততদিনে যথেষ্ট সংখ্যক লোককে পথভ্রষ্ট করে নিয়েছিলো এবং এক বিরাট সৈন্যবাহিনীও গঠন করেছিলো। তার মূলোৎপাটনের জন্য প্রথমে সাইয়্যেদুনা হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলেন।
এরপর সাইয়্যেদুনা হযরত শারজীল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান; কিন্তু তিনিও সফল হননি। পরিশেষে, হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সৈন্যদল নিয়ে যুদ্ধে গেলেন। তুমুল যুদ্ধ হয়েছিলো। একুশ হাজার মুরতাদ্দ্ জাহান্নামে পৌঁছেছিলো। আর এক হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন; যাঁদের একটি বিরাট অংশ পবিত্র ক্বোরআনের হাফেয ছিলেন।
এ যুদ্ধে মুসায়লামা কায্যাবের গর্দান উড়ানোর মতো বাহাদুরীর মুকুট হযরত ওয়াহ্শীর মাথায় শোভা পেলো। তিনি তাকে জাহান্নামে পৌঁছিয়ে উহুদ যুদ্ধে হযরত হামযাহ্কে শহীদ করার প্রায়শ্চিত্ত (কাফ্ফারা) করেছিলেন। এ যুদ্ধের নাম ইতিহাসে ‘ইয়ামামাহ্র যুদ্ধ’। মোটকথা, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কারো নুবূয়ত দাবী করা হযরত সাহাবা-ই কেরাম সহ্য করেননি। সাজাহ্ ও তুলায়হারও একই ধরনের পরিণতি হয়েছিলো। তারাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।
সাহাবা-ই কেরামের ইজমা’ (ঐকমত্য)
যেসব হযরত নিজ নিজ শির হাতে নিয়ে ইয়ামামার যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন, যাঁরা শাহাদাতের সুধা পান করে তৃপ্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই সাহাবী ছিলেন এবং নবী করীমের দরসপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁদেরকে মুসায়লামা কাযযাবের মোকাবেলায় পাঠানো এবং তাঁদেরও যুদ্ধ করা ও শহীদ হওয়া একথা প্রমাণ করে যে, সম্মানিত সাহাবীদের সবার মতে হুযূর সাইয়্যেদুল ‘আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। তাঁর পরে কোন প্রকারের নবী হবার দাবী করা কুফরী ও মুরতাদ্দ হয়ে যাওয়াই। আর নুবূয়তের ওই মিথ্যা দাবীদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জরুরী। প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত সম্মানিত সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম খতমে নুবূয়তের মাসআলায় একমত ছিলেন। আর আজ পর্যন্ত সত্যপন্থীদের এই মসলক (মতাদর্শ)ই চলে আসছে যে, রাব্বুল আলামীনের মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী।
—০—
খতমে নুবূয়তের উপর সল্ফে সালেহীন
(ইসলামের অগ্রণী বুযুর্গগণ)-এর ঐকমত্য (ইজমা’)
প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরের দীর্ঘ সময়ে আজ পর্যন্ত মুসলমানগণ ‘খতমে নুবূয়ত’-এর মাসআলায় একমত হয়েছেন; এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে সলফে সালেহীনের কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির ‘খতমে নুবূয়ত’ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ও আক্বীদা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি-
ইমাম গাযালী
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘‘সুতরাং এ কারণেই হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে নুবূয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আর তিনি এরশাদ করেছেন-لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (আমার পরে কোন নবী নেই।) [ত্বিব্বে জিসমানী ও ত্বিব্বে রূহানী, কৃত. ইমাম গাযালী]
ইমাম রাব্বানী
হযরত ইমাম রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী ক্বুদ্দিসা র্সিরুহু বলেন, ‘‘খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ হাস্ত ওয়া ঈসা নুযূল খা-হাদ নমূদ ওয়া আমল বশরী‘আতে ঊ-খাহাদ করদ।’’ অর্থাৎ ‘‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল, সর্বশেষ নবী, হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম অবশ্যই অবতরণ করবেন এবং তাঁর (হুযূর-ই আক্রাম)-এর শরীয়ত অনুসারে কাজ করবেন।’’
তিনি অন্য এক জাযগায় বলেছেন, اول ایشاں آدم است وخاتم ایشاں محمد رسول اللہ ﷺ অর্থাৎ নবীগণের মধ্যে দুনিয়ার সর্বপ্রথম হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম তাশরীফ এনেছেন এবং সব শেষে তাশরীফ এনেছেন আল্লাহর রসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। [মাক্বতূবাত শরীফ]
মাওলানা রূমী
জনাব মাওলানা রূমী কুদ্দিসা র্সিরুহুল আযীয বলেছেন-
یارسول اللہ رسالت را تمام -تونو دي سمچو شمس بے گماں [مثنوی شریف]
অর্থ: হে আল্লাহর রসূল! আপনি রিসালতের ধারাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। একথা আপনি মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন। [মসনভী শরীফ]
হযরত মাহবূবে সুবহানী
হযরত পীরানপীর দস্তগীর সাইয়্যেদুনা মাওলানা হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী ক্বুদ্দিসা সিররুহুল আযীয এরশাদ ফরমান-
سب اہل اسلام کا عقیدہ ہے کہ محمد بن عبد اللہ بن عبد المطلب بن ہاشم (ﷺ) خداوند تعالی کے رسول اور رسولوں کے سردار اور نبوت ان پر ختم ہے -[غنیہ الطالبین صفحہ ۱۱۴]
অর্থ: সকল মুসলমানের আক্বীদা বা দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে- হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার রসূল, রসূলগণের সরদার এবং নুবূয়ত তাঁরই উপর সমাপ্ত হয়েছে। [গুনিয়াতুত্ ত্বা-লেবীন, পৃ. ১১৪]